রবিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১

শর্মিষ্টা দত্ত

                                




না ফেরা পথে 

**************

রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর l অন্ধকারের বুক চিরে দ্বারকা থেকে বৃন্দাবনের দিকে উল্কার  গতিতে ছুটে চলেছে একটি স্বর্ণরথ l সোনার পালঙ্কে ঘুমন্ত রাজমহিষী সত্যভামার পাশ থেকে উঠে কাকে দেখার জন্য আজ ব্যাকুল কৃষ্ণ ! এ জীবনে কাঙ্খিত যা কিছু সবই তো পাওয়া হয়ে গিয়েছে তাঁর l অর্থ, যশ, প্রতিপত্তি, প্রেম সব সব l এই সুবিশাল ভারতবর্ষের রাজনৈতিক মানচিত্রে দ্বারকা এখন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এক রাজ্য l এখানকার সমৃদ্ধি সারা ভারতবর্ষের নাগরিকদের মুখে মুখে ফেরে l দ্বারকাধিপতি কৃষ্ণের অঙ্গুলিহেলনে চালিত হন ভারতের তাবড় ক্ষমতাবান নৃপতিরা l তাঁর মত বিদগ্ধ কূটনীতিক কোন অভাববোধ থেকে ছুটে চলেছেন ক্ষুদ্র এক জনপদের দিকে ! 

রাজকার্যে সারাটাদিন কেটে যায়, তারপরে নানারকম সামাজিক ও পারিবারিক দায়বদ্ধতা পালন করে প্রায় মধ্যরাতে  নিজের সঙ্গে একা হন কৃষ্ণ l একটুআগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে l আকাশ ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, তারা দেখা যায় না l অনেকদিন পরে কানে ভেসে এল বাঁশির সুর l মিঞামল্লারে কে বাঁশি বাজায় ? কোন রাখালবালক ? সঙ্গে নারীকণ্ঠে মৃদুস্বরে উচ্চারিত কিছু শব্দ... 
"জনম অবধি হাম রূপ নেহারলু 
নয়ন না তিরপিত ভেল l
সোই মধুর বোল শ্রবণহি শুনলু 
শ্রুতিপথে পরশ না গেল ll
কত মধুযামিনী রভসে গোঁয়ায়েলু 
না বুঝলু কৈছন কেল l
লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখলু 
তব হিয়া জুড়ন না গেল ll"
বড্ড চেনা এই সুর ও বাণী l 
বিস্মৃতির অন্তরাল থেকে মূর্ত হয়ে ওঠে এক প্রতিচ্ছবি l যমুনার তীরে অপেক্ষমান এক নারীমূর্তি l ঘননীল আকাশের প্রেক্ষাপটে স্পষ্টতর হাতির দাঁতের মত তাঁর গাত্রবর্ণ l ডালিমফলের মত রক্তিম ওষ্ঠ আর  টানাটানা হরিণীর মত কালো চোখে অন্তহীন আকুতি l যমুনার নীল জলের থেকেও গাঢ়  অঙ্গবাসের আড়াল থেকে স্পষ্টমান তাঁর অনিন্দ্যসুন্দর দেহ সৌষ্ঠব l 

আর ঘরে থাকতে পারেন না কৃষ্ণ l নিজের উচ্চাকাঙ্খাকে  কর্তব্যপরায়ণতার মোড়কে মুড়ে  একদিন যে গ্রাম ছেড়ে চিরতরে চলে এসেছিলেন মথুরায়, এক নারীর চোখের জলকে অস্বীকার করতে দ্বিধা করেননি, সেখানেই ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়লেন তিনি l ওই তো সেই ঘাট, নৌকা বাঁধা আছে এখনও l গোপললনারা কি এখনও মথুরায় দধি বেচতে যাওয়ার জন্য পারাপার করে ! রাইও কি আছে তাদের দলে?  নাহ, তা কি করে হবে ! রাই কি এখনও সেই ভরা যুবতীটি আছে ! তাঁরও তো বয়েস হয়েছে নাকি ! সে তো কৃষ্ণের থেকেও বয়েসে বড় l তবু তাঁকে এক পলকের একটু দেখার জন্য কৃষ্ণের মত প্রাজ্ঞ হিসেবী মানুষও ছুটে আসে !
রথ থেকে নেমে গাঁয়ের পথে হাঁটতে থাকেন কৃষ্ণ l এ গাঁয়ের পথঘাট হাতের তালুর মত চেনা তাঁর l এত বছরে কিছুই বদলায়নি এখানে l ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ান আয়ান ঘোষের বাড়ির সামনে l ওই তো দধিমন্থধ্বনি শোনা যায় l রাত্রি তৃতীয় প্রহর, এসময়ে ঘুম থেকে উঠে গোপললনারা গৃহকর্ম শুরু করে l ভোরের আলো ফুটতেই দধিভাণ্ড নিয়ে হাজির হয় যমুনার কূলে l সরল, সাদাসিধে যাপন এদের l কৃষ্ণের জীবনটাও কি এমন হতে পারত না ! এখন সারা ভারতবর্ষের মানুষের মুখে মুখে ফেরে  তাঁর নাম, কীর্তির কথা l এটাই কি জীবনের কাছে চাওয়ার ছিল তাঁর ! একের পর এক সাফল্য মুঠোতে এসেছে, আর এই সারল্য থেকে, প্রেম থেকে ক্রমশ দূরে সরে গেছেন তিনি l অথচ কি নেই আজ কৃষ্ণের জীবনে? পারিবারিক জীবনও পরিপূর্ণ তাঁর l সুন্দরী স্ত্রী, কীর্তিমান পুত্র l কিন্তু সে জীবনে রাই নেই l রাইয়ের প্রেম নেই l সে জীবন এই ঘনঘোর বর্ষার রাতের থেকে গাঢ় অন্ধকার l 

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন কৃষ্ণ l রাই কি থাকে না এখানে ! উঠোনে কর্মব্যস্ত নারীদের মধ্যে তাকে দেখা যাচ্ছে না তো ! কুঞ্জবনের দিকে ফিরে চললেন তিনি, বংশীবটের ছায়ার এসে এক মুহূর্ত থামলেন l ওই তো গাছের কোটরে গুঁজে রাখা মোহনবাঁশি l ঠিক যেমন অনেক অনেক বছর আগে কানু রাখত l সেদিন চন্দ্রাবলীর কুঞ্জে রাত্রিবাস করে ফেরার পর রাগ করে কথা বলেনি রাই l  ওই কুঞ্জবনে বসে মুক্তোদানার মত হস্তাক্ষরে লিখেছিল, 
"বঁধু, কি আর বলিব তোরে 
অলপ বয়সে পিরীতি করিয়া 
রহিতে না দিলি ঘরে l 
কামনা করিয়া সাগরে মরিব 
সাধিব মনের সাধা 
মরিয়া হইব শ্রীনন্দের নন্দন 
তোমারে করিব রাধা ll" 

রাত্রি শেষ প্রহর l পূব আকাশ রাঙা হয়ে এল l ঘোর কাটে কৃষ্ণর l এবার ঘরে ফেরার পালা l আবার রাজা সেজে কর্তব্যের ঘেরাটোপে বন্দী হতে হবে l দীর্ঘশ্বাস ফেলে রথের দিকে এগিয়ে যান তিনি l হঠাৎই কুঞ্জবনের ভিতর থেকে সঙ্গীত ভেসে আসে, 
"আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়েলু 
পেখলু পিয়া-মুখ-চন্দা l 
জীবন যৌবন সফল করি মানলু 
দশ দিশ ভেল নিরদন্দা ll" 
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন কৃষ্ণ l ভাবোল্লাসে মগ্ন এক নারী সুরের মায়াজাল বুনে চলেছে আপনমনে তার সামনে কানুর একটি মৃৎপ্রতিমা l সময় একটিও আঁচড় কাটতে পারেনি তার শরীরে l চিরযৌবনা শাশ্বতী রাইয়ের সামনে থেকে সরে আসেন প্রৌঢ় দ্বারকাধিপতি l তিনি তো এখন আর সেই ব্রজের  রাখাল বালক নন, রাইয়ের সামনে দাঁড়ানোর যোগ্যতা কই তাঁর ! ভালো থাকুক রাই তার কল্পনার জগতে l রাখালরাজা ভরিয়ে রাখুক তার সমস্ত সত্ত্বা l  স্বর্ণরথ ফিরে যায় লৌকিক সুখসমৃদ্ধির পথে l শুধু বৃন্দাবনের পথের ধুলোয় মিশে থাকে তাঁর কান্নাজলের দাগ l 

1 টি মন্তব্য: