শনিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১

সুবীর সরকার

                            


গৌরীপুরের পান আর গোলকগঞ্জের গুয়া ( ষষ্ঠ পর্বের পর)
সুবীর সরকার 


৭.
এত এত হাট,এত এত গঞ্জ,এত এত নদীপরিধির ভেতর মানুষের বেঁচে থাকা।বেঁচে থাকতে থাকতে আবহমান এক জীবনকে বারবার পাল্টে পাল্টে দিতে থাকা।ইয়াকুব মহিউদ্দিন লোকমান সাজু চোরা আরো কত বর্ণময় আর বিচিত্র মানুষের সমাবেশ দিয়ে সেজে ওঠে গঞ্জহাটের এক চিরকালের ভুবনজোত।
এক হাট থেকে মানুষকে চলে যেতে হয় অন্য কোন হাটে।নুতন নুতন হাটে।নয় ফরেস্ট আর কুড়ি নদীর দুনিয়ায় কত যে হাট!
ইয়াকুব একবার পানবাড়ি হাটে গিয়ে ফেরার পথে পথ ভুলে গিয়েছিল।তাকে কি তবে ভুলায় ধরেছিল!
বগরিবাড়ির যতীন ডাকাতের সাথে দেখা হবার পর পরেই ইয়াকুব যতীন কে হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিল চিকন চিড়ার হাটখন্ডের দিকে।সেখানে বসে দই চিড়া খেতে খেতে যতীন তার ডাকাতিয়া জীবনের রোমহর্ষক সব গল্পের ঝাঁপি খুলে বসেছিল।
লালজি রাজার ভাই প্রণবেশ সাহেবের সামনেই তো একবার ব্রহ্মপুত্রে জেগে ওঠা নয়া চরে চরদখলের লাঠালাঠিতে কি এক ভয়ানক লড়াই!সেবার মাথা ফেটেছিল যতীনের।
যতীনের ডাকাতিতে হাতখড়ি হয়েছিল বিজনির হামিদ মিদ্দার কাছে।তিরিশ বছর ডাকাতির জীবনে একবারই যতীনকে থমকে যেতে হয়েছিল!তার চোখ কান্নায় ভিজে গিয়েছিল!এবং এই প্রথমবার পুলিশের হাতে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছিল সে।
সেবার ডাকাতি করতে গিয়েছিল যতীন রূপসীর নন্দ ধনীর বাড়িতে।খবর ছিল তামাক বিক্রির প্রায় তিন লক্ষ টাকা ধনীর বাড়িতেই রাখা আছে।আছে প্রচুর স্বর্ণালঙ্কার।ধনসম্পত্তি।
মধ্যরাতে দল নিয়ে যতীন হানা দিয়েছিল নন্দ ধনীর বাসায়।তারপর সে এক ধুন্ধুমার মারি ফেলা কান্ড!
হঠাৎ নন্দ ধনীর বছর পাঁচ বয়সী বাচ্চা ছেলে যতীনের হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নিতে এলে যতীন আত্মরক্ষার জন্য বন্দুক চালিয়ে দেয়।
চোখের সামনে ছটফট করতে করতে সেই বাচ্চাটির মৃত্যু যতীনকে হতভম্ব করে দেয়।
তারপর সব ইতিহাস।জেল থেকে বেরিয়ে যতীন ডাকাতি ছেড়ে দেয়।যোগ দেয় কুষাণ গানের দলে।
দোয়ারির ভূমিকায়।মাঝে মাঝে কীর্তন করে বেড়ায়।
আর ইচ্ছে মত দোতরা কাঁধে ঘুরে বেড়ায় কোন কোন হাটে।দাতের মাজন,হজমি গুলি,কবিরাজি ওষুধ বিক্রি করে আর গান করে ফাঁকে ফাঁকে।
আর দেখা হলেই চেনা বা অচেনা লোকজনকে শোনাতে থাকে ডাকাতিয়া জীবনের নানান গল্পকথা।
জীবন কি অদ্ভুত!
ঘোর লাগা দুই চোখ জাগিয়ে রেখে যতীন বিড়বিড় করে গান তোলে_
"এপার থাকি না যায় দেখা রে
নদীর ওই পারের কিনার"
৮.
ইউসুফ মোল্লার বেশ মনে পড়ে শালমারার বড় বালার চরে বড় রাজকুমারীর গান নিয়ে নাচ নিয়ে বাদ্য বাজনা নিয়ে এক শীতের রাতে জমিয়ে তোলা গানবাড়ির কথা।ইউসুফ মোল্লা তখন সদ্য যুবক।পালতোলা নৌকোর দুরন্ত মাঝি।ব্রহ্মপুত্র শাসন করে সে।পণ্য পৌঁছে দেয় বন্দরে বন্দরে।আর নেশা বলতে গানবাড়িতে ঘুরে ঘুরে গান শোনা।
তখন রাজবহাদুর প্রভাত বড়ুয়া বেঁচে।
শিকারে যান মস্ত দাঁতাল হাতি জংবাহাদুরের পিঠে চড়ে।বড় রাজকুমারী আর ছোট রাজকুমারী তখন গঞ্জ গা হাট ঘুরে ঘুরে গান,নাচ, শোলোক খুঁজে বেড়াচ্ছেন।নিজেরাও নাচছেন।গাইছেন।
বালাবাড়ির চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে সেই সব গান।যা চিরকালীন।যা ভরভরন্ত জীবনের কথা বলে_
"কালা বাইগণ ধওলা রে
বাইগণের গোড়ায় কাটা"
এক হাট থেকে বেরিয়ে নুতন এক হাটে প্রবেশ করতে গিয়ে এই চার কুড়ি পেরিয়ে আসা জীবনে বারবার ইউসুফ মোল্লার মনে পড়ে সেই সব সোনার বরণ পাখির মতন দিনগুলির কথা।
হায়রে,কত তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নেমে আসে মানুষের জীবনে!জলে ভিজে ওঠে ইউসুফের চোখ। সে দেখতে পায় "টলমল টলমল কচুপাতের পানি"।
ঠিক এখানেই একটা গল্প শেষ হয়ে যায়,নুতন এক শুরুর অপেক্ষায়!


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন