শনিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১

সোনালী চক্রবর্তী

                                



মহাফেজ



'অনুভূতির অনুবাদ সম্ভব নয় বলে কখনো কবিতা পড়িনি'- প্রিয় অধ্যাপকের সঙ্গে দেখা করতে আসা এক কৃতির সঙ্গে আলাপচারিতায় মগ্ন নীলাদ্রির মুখ থেকে বেরিয়ে আসা কথাদের মধ্যে শুধুমাত্র এটিরই বিক্ষেপ দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিলো সেদিন স্বধার। "কানের ভিতর দিয়া মরমে" পৌঁছানো সব কিছুই যে ধনাত্মক হবে এমন আইন না থাকায় স্বধার তাকে আত্মিকরণে সমস্যা হয়নি বরং সে ভাবতে চেয়েছিলো যে সাতটি স্তর অতিক্রম করে কোনো ছেলেকে পুরুষ হয়ে উঠতে হয়, তা পেরনোর পর পরিখা বুজিয়ে দেওয়া হয় কেন? অথবা 'মেধা নাড়ি' জাগ্রত হলে যে কোনো পুরুষই কি প্রস্তর?


ইডেনের কেবিন ওয়ানে অদ্ভুত সুন্দর কুট্টি একটা ব্যালকনি আছে। খুব বেশী হলে চার পাঁচজন সেখানে একসঙ্গে দাঁড়াতে পারে। গ্রিলের ওপারে কোনো এক কালে প্রতিষ্ঠিত, বর্তমানে মৃত ব্যবসায়ীর গোলা, পরিত্যক্ত গ্যারেজ। বাঙালীর ব্যবসা এখনো 'এক পুরুষের' এই বদনাম ঘোচাতে পারেনি এই শহরতলিতে অন্তত, সেহেতু দীর্ঘ দীর্ঘ গাছেরা ক্রমেই দীর্ঘতর হয়ে শিকড়ের দিকের আগাছাকে জঙ্গল করে তোলার বন্য আনন্দ পেয়েছে। সাত পা একসঙ্গে হাঁটলে বন্ধু হয় অথবা সপ্তপদীতে যাপনের সঙ্গী? প্রথম সাত মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর স্বধার মনে হয়েছিলো অরণ্য ভালবাসে বলে তার সাতজন্ম লতা গুল্মে জড়িয়ে থাকার সুযোগ পায় নিয়ত। তবে তখনো সে জানতো না আগামী প্রায় সাতশ ঘন্টায় চাণক্য মতে প্রকৃত বান্ধব তার এই ছোট্ট নির্জনটুকুই হয়ে উঠবে। এই মুহূর্তে এই মধ্যরাতে এখানেই দাঁড়িয়ে কেন হঠাৎ সেদিনের ভাবনার কথা তার মনে পড়লো, কারণ খুঁজতে গিয়ে সে অন্ধকারেই হারাতে চাইল।


আলেকজান্ডার পোপ নামের কবিটি সেই অগাস্টান পিরিয়ডে যে অসামান্য কিছু কথা লিখে গিয়েছিলেন স্বধা সেগুলোকে মানে ভীষণভাবে, নিজেকে দিয়েই। "A little learning is a dangerous thing" পাতি বাংলায় যাকে বলে "স্বল্পবিদ্যা ভয়ংকরী"। নিজেকে বাচাল মেনে নিয়েছে এই কারণেই। পূর্ণ কলসে শব্দ হয় না। সে অত্যন্ত অগভীর, ফাঁকা তাই এত এত কথা আসে তার, এমনই মনে হয়। সেও ঐ মনতস্ত্ব বিষয়ে বিশেষ পড়াশুনা না করেই ফ্রয়েডিয় কোট আউড়ানো লোকগুলোর দলে যারা অবসাদগ্রস্ত কাউকে পাগল আখ্যা দিয়ে দেয় নির্বিচারে, উড়ে উড়ে আসা গল্প কবিতায়, ইউ টিউবের লিঙ্ক দেখে ওয়েদিপাউস আর ইলেক্ট্রার প্রসঙ্গ এনে ফ্যালে, অথচ একটু তলিয়ে ভাবলে, সামান্য অনুধ্যানেই স্পষ্ট হতো যে কোন নারী তার প্রার্থিত পুরুষের মধ্যে জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে তার পিতাকেই সন্ধান করে এবং ভাইসি ভার্সা। কমপ্লেক্স ভিন্ন বিষয়। অতি সরলীকরণ কোনো জটিলতার না হওয়াই যুক্তিযুক্ত। 


স্বধার মনে হলো যেভাবে জয়েস নোরাকে লিখেছিলেন "তোমার সমাজ আমার শত্রু, তুমি নও", ঠিক সেভাবেই সে যে যে 'পুরুষ' দেখেছে এই তিরিশ অবধি তাদের অধিকাংশই পুরুষমাত্র, তন্ত্রধারী নয়। তাদেরকেও তার বলতে ইচ্ছে হয়েছে- 'আমি পুরুষতন্ত্রকে প্রতিপক্ষ মেনেছি, তোমাকে নয়'। পারেনি কারণ প্রকৃতি আর পুরুষের মূল ব্যবধান বাড়বাগ্নিতে। নারী এক জলজ সত্ত্বা, যে কোনো অভিঘাতের প্রতিসরণ তার আধারে বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। পুরুষ নিরেট এক অস্তিত্ব, উদ্বেদী শিলাকে ধারণ করে থাকা আপাত প্রতিক্রিয়াহীন ঘন অবস্থান। অভিমান শব্দ মাত্রেই রমণীয় মেঘ ভেসে আসে অথচ তার প্রকৃত স্বরূপ হয়তো পুরুষেরই করায়ত্ত। সে স্থির হয়ে যায়। মন্দ্র নিনাদের প্রতিশ্রুতি নিয়ে নিস্তব্ধ কাঠিন্যে। যেমন কস্তুরীর বধবিন্দু তার শরীরস্থ ব্রহ্মকুণ্ডলীটিই ঠিক সেভাবেই পুরুষের অসহায়তা সে একজন পুরুষ'ই। একথা নীলাদ্রীকে পড়ে প্রথম জেনেছে স্বধা, পরবর্তীতে প্রতিটি ঈশ্বরসত্ত্বা, পরিযায়ী কিছু ঘনিষ্ঠরা তার পাঠকে নিবিড় করেছে, আপাতত ক্রাইস্ট শেখাচ্ছে আর একদম স্বচ্ছতায় আজ আরেকজনের বোধে দেখল। একটা গান মনে পড়লো- "একলা পুরুষ কর্তব্যে, একলা পুরুষ পিতায়"।

রিসেপশন থেকে আর্জেন্ট কল আসার পর দেখা করতে গিয়ে সে জেনে ফিরেছিলো ডক্টর সেনের বিশেষ নির্দেশের কথা। যেমত সে নিশাচর হলেও পাখি নয়, অসম্ভব বিধ্বস্ত মাথা আর শরীরের ইন্সট্যান্ট এলাইনমেন্ট সম্ভব হয়নি। বসে পড়েছিল। সামনে প্রবল অন্ধকার কড়কড়ে রোদ্দুরে, যতটা দৃশ্যময় তার থেকে অনেক বেশী অনিশ্চয় অদৃশ্যে। সে কোথায় নিয়ে যাবে এখন এই নিদ্রিত, অসুস্থ মানুষটিকে? তাবড় সেলিব্রিটিদের যেখানে আই সি ইউ পাওয়ার অপেক্ষা করতে হচ্ছে, স্বাস্থ্যভবন নথিকরণ বন্ধ করে দিচ্ছে ওয়েটিং লিস্ট মুনওয়াক হয়ে গেছে বলে, লকডাউনের রাস্তা দিয়ে যাওয়া প্রতি দশ মিনিটের ছটা গাড়ির মধ্যে তিনটে এম্বুলেন্সের, একটা শববাহী যানের। সে কোথায় নিয়ে যাবে? সে এমন রাষ্ট্রে বাস করে যা বিশ্বব্যাপী অতিমারির প্রথম ঢেউ প্রত্যক্ষ করার পর দেড় বছর সময় পায় পরবর্তী আঘাত আসার আর সেই অন্তবর্তী সময়টুকুকে উপভোগ্য করে তোলে শুধুমাত্র কয়েকটি রাজ্যের নির্বাচনী আমোদে। একশন প্ল্যান, হসপিটাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র তো দূর, একটিও অতিরিক্ত বেড, এক বোতল রক্ত, একটামাত্র সিলিন্ডারের সরবরাহকেও উপেক্ষা করে দিয়ে হত দরিদ্র জনসাধারণের করের অর্থভাণ্ডার দেউলিয়া করে দেয়  কোটি কোটি টাকার কপ্টার ভাড়ায়, ব্যাক্তিগত প্রচার বরাদ্দ খাতে। হায় দেশ... সে কোন দুয়ারে কড়া নাড়বে এখানে? নীলাদ্রীর ছাত্ররা ছড়িয়ে আছেন পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়, সামান্য হলেও কিছু মন্ত্রী সান্ত্রী গুরুত্বপূর্ণ আধিকারিক স্বধাকে স্নেহে রাখেন কিন্তু তারা কি মহানগরীতে ময়দানবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন? না রক্তবীজি প্রজননে চিকিৎসকের জন্ম দেবেন কেন্দ্র রাজ্যের প্রশাসনিক মান রক্ষার্থে? থাকলো বাকি এই মহকুমা মফস্বল। যে হাজারে হাজারে গ্রামবাসীদের দুইদিন আগেও ট্রাক বোঝাই করে এনে এনে তারকা খচিত মঞ্চের মাঠ ভরানো হয়েছে ক্যাডারদের বিশ্বস্ত তত্ত্বাবধানে, তারা তো জানতেও পারেনি মাস্ক কী, দূরত্ববিধি কাকে বলে? অজান্তেই তাদের আয়ুর সুতো ছিঁড়ে গিয়ে এখন কাতারে কাতারে মাথা জমছে সরকারী হাসপাতালে ফলে নরককেও প্রতিযোগীতায় নামতে হচ্ছে ন্যূনতম পরিষেবার প্রেক্ষিতে। এ বস্ত্রহরণ পালার দুর্ভাগ্য রুখতে মাধবও প্রতিবন্ধী। তাহলে নীলাদ্রি কোথয় যাবেন? বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে তাকে? উদ্ভ্রান্ত স্বধার কল লিস্ট জানে পরপর সত্তর টি ফোন সে করেছিলো ইডেনেরই দুই তিনজন ওয়ার্ড বয় এমনকী সুইপারের হাতে মোটা টাকা গুঁজে দেওয়ার বিনিময়ে নম্বর জোগাড় করে (রাজপথে অন্ধকারের বিকিকিনি হয়না বলেই কানাগলি গুলো টিঁকে থাকে) সম্ভাব্য সমস্ত নার্স আর আয়াদের, পায়নি, একজনকেও নয়। 

নির্দেশ পাঠিয়ে দেওয়ার পর ঘুম তারও আসেনি। খুব ভোরে ডিউটি থেকে সরাসরি পৌঁছে গিয়েছিলেন ইডেনে। কেন, এর উত্তর জানা থাকা বলেই আয়নার সঙ্গে পুরুষদের বড়ই বৈরিতা। ভিতরে ঝড় বইলেও তাদের চোয়াল, ভাঁজ ফুটিয়ে তোলার বিশ্বাসঘাতকতা করে না। একবার পূর্ণ দৃষ্টিতে কেবিন ওয়ানের দিকে তাকিয়ে রিসেপশনে যা জানানোর জানিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন যেখানে অপেক্ষায় তার আত্মা ও রক্তের পুত্তলিরা। রিসেপশন থেকে প্রতিনিধি এসে স্বধাকে জানিয়ে গিয়েছিলো, পূর্ব পরিচিত নীলাদ্রীর দায়িত্ব ডক্টর সেন অন্য কোথাও, কারোর হাতে ছেড়ে দিতে অস্বীকৃত হয়েছেন, তাকে ডিসচার্জ করা যাবে না। যখন স্বধা শুনছিলো এই কথা, দেখতে পেলো সায়রের গাড়ি পোর্টিকো ছেড়ে রাস্তায় নামলো সদ্য। 

নীতি, আদর্শ সব সব কিছুকে শব্দ মাত্র ধরে নিলেও সিংহের হৃদয় জানে 'একা' চারণের ক্ষমতা ধারণ করে বলেই সে নৃপতি। কাকে কৈফিয়ত দিয়ে এলেন সায়র আজ? নিজেকে? "ধরিত্রী দ্বিধা হও"- এক নারী উচ্চারণ করতে পারে, পুরুষ নয়। সে জানে তাকে নিয়ম গড়তে হবে, ভাঙতেও হবে অথচ কলঙ্কমাত্র যেন স্পর্শ না করে, সে দূরত্বও গাঁথতে হবে। 'টান' -অলীক এই শব্দকে পাঁজরে আটকে রেখে গলিয়ে নিতে হবে নীতিমালার শৃগালচর্ম। নাহলে তার ঘ্রাণে সহস্র হারপুন হাতে উল্লাসে ঘিরে ধরবে শ্বাপদদুর্লভ নৃশংসতারা। সে গরল নিজে নিয়ে নীলকণ্ঠ হবেন, এমনও এক্তিয়ার নেই। তিনি যে কারোর স্বামী, কারোর পিতা। তার সর্বস্ব দিয়ে হলেও স্বধাকে প্রত্যক্ষে আগলে রাখার অধিকার বা অনুমোদন কোনটাই তিনি নিজেকে দিতে পারেন না। শুধু আড়ালে থেকে নিরাপদ গণ্ডী টুকু কেটে দিতে পারেন মাত্র। কেউ যেন টের না পায়, যে লক্ষ্য সেও নয়। বজ্র দৃঢ় অথচ অসহায় এই পদক্ষেপের সংজ্ঞা- পুরুষ জানে, তার যমুনা নেই, কলসীও না। 


শুধু তাদের এটুকু জানা হয় না, সায়রেরও হলো না, 'ইনটিউশন' বলে যে শব্দটি আছে অথবা ষষ্ঠেন্দ্রিয়, তা নারীর অজ্ঞাত কিছু রাখতে দেয় না বলেই "স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম দেবা না জানন্তি, কুতো মনুষ্যা:"- এই প্রবাদ এসেছে। একটিও শব্দ উচ্চারণ না করলেও পুরুষের প্রতিটি আচরণের সুলুক সন্ধান নারীর কাছে প্রিজমের উজ্জ্বলতায় ধরা পড়ে। তার মনে পড়লো ভ্রূণহত্যা বা কন্যাসন্তান জন্মানোর অপরাধে খুনের খবরেরা যেদিন সংবাদপত্র আঁধার করে থাকতো, নীলাদ্রী লুকিয়ে রাখতেন। নৃশংস ধর্ষনকান্ডেরা যখন প্রচারমাধ্যমের খাদ্য হতো, স্বধার ঘনিষ্ঠ বান্ধবেরা চুপ হয়ে যেত কিছুদিনের জন্য হলেও। আজ সায়রকেও দেখলো সে, অবিকল হংলি, নিষ্পাপ জেনেও রুয়িকে কোল্ড প্যালেসে পাঠিয়ে ব্যাক্তিগত প্রহরায় রাখা সম্রাট। একটিই নরমে প্রত্যেকে বিদীর্ণ, পুরুষোচিত সংবেদন। নপুংসক পুরুষত্ব প্রমাণের দায়ে যখন যে মুহূর্তে কোনো মেয়ে আহত বা নিহত হয়, যে বা যারা মাথা নিচু করেন লজ্জায়, দীর্ণ হন আত্মসংকটে, সংগোপনে- অতি সংক্ষেপে তাদেরকেই স্বধা 'পুরুষ' নামে ডাকে। সম্ভবত সেই কারণেই কোনো এক সেমিনারে পেপার পড়ে নামার পর যখন এক বিশিষ্ট গবেষক তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন "Proud to see an emerging feminist" , সে গ্রহণ করতে পারেনি। কাষ্ঠ হেসে জানিয়েছিলো- "Thanks a ton but I would love to call myself a humanist as I have seen pangs of the first sex before learning mine" 


বেধড়ক সবুজে দুটো কাঠবিড়ালির বাসা। অষ্টপ্রহর ঝিলিক দিয়ে লাফিয়ে বেড়ায় শাখা থেকে প্রশাখায়। স্বধা তাকিয়ে আছে। ভাঙা রেমিঙটন পড়ে আছে জীর্ণ শেডের আড়ালে। অনেকদিন কিছু লেখেনি সে, অনেকদিন। মনে হয় কিছু দ্বন্দ্ব অমীমাংসিত থাকে বলেই তারা অনন্ত আকর্ষণের, যেমন পুরুষ ও প্রকৃতির অথবা জল ও প্রস্তরের।

কে কাকে বোঝে?
কে কাকে বোঝায়?
কে কাকে বুঝতে দেয়? 

ছবি - অন্তর্জাল

২টি মন্তব্য: