শনিবার, ২৬ জুন, ২০২১

তুষ্টি ভট্টাচার্য

                                                     



সাইকেল ( সপ্তম পর্বের পর)

 #৮

পরদিন ভোর থেকে সামুয়েলকে আবার সাইকেল নিয়ে ভ্রমণে বেরোতে দেখল সবাই। সেই আগের মতো মুখে হাসি, আর সুরের গুনগুনানি। তবে বেলার দিকে সে বুলবুলের সঙ্গীদের ডেকে নিল সেই গাছের তলাতেই। তারপর ওদের সঙ্গে ঘন্টাখানেক আলোচনা চলল ওর। অভিজিৎ একটা খাতা, পেন নিয়ে বসে গম্ভীর মুখে কী যেন লিখছিল সেই সময়ে। দূর থেকে ওদের দেখছিল পথচলতি গাঁয়ের লোকজন। কেউ কেউ হেঁকে জিজ্ঞেসও করল, ‘কী গো, এখানে কিসের মিটিং চলছে তোমাদের?’ বুলবুল হেসে বলল, ‘কাকা, কাল তোমাদের বাড়ি যাব আমরা। গিয়ে সব বলব’। কাকাও ঘাড় নেড়ে হেসে চলে গেল। অভিজিতদের বাড়িতে একটা পরিত্যক্ত গোয়াল ঘর ছিল। দুপুরে খেয়েদেয়ে পুরো টিম সেই ঘর ছাইতে শুরু করল। ওদের দেখাদেখি আরও কয়েকটি খুদে এসেছে দুপুরে। কী হচ্ছে বা কী হবে, এই নিয়ে সকলের কৌতূহল খুব। অভিজিতের মা, বাবা, কাকা, কাকিমারা এখন পৃথক রান্নাঘরে রান্না করে। তবে তাদের একটি যৌথ রান্নাঘর ছিল আটচালার। সেই ঘর এতদিন বন্ধই পড়ে থাকত। আজ শেকল খুলে সেই ঘরকে পরিষ্কার করতে লেগে গেছে সারা পরিবার। সে এক হৈহৈ কাণ্ড! কেউ কেউ ভাবছে গাঁয়ের কারুর বিয়ে লাগবে নাকি? অভিজিতের বিয়ে হলে তো এতদিন সবাই জানতে পেরে যেত। যাইই হোক না কেন, এই লক ডাউন পর্বে কিছু একটা যে হতে চলেছে এই গ্রামে, সে নিয়ে জল্পনা কল্পনা চলল সারা দিনভর।

বরবরুয়াদের জমিজমার অভাব নেই বটে, তবে নগদ টাকার জোগান কম। এদের গ্রামের বেশির ভাগ চাষীরাই এখনও বিনিময় প্রথায় কাজ মেটায়। ধানের বদলে তিসি, সর্ষের বদলে আনাজপাতি…এইরকম। এই আদানপ্রদানের ব্যবস্থাকেই কাজে লাগিয়েছে সামুয়েল। বুদ্ধি তারই। তার কাজের ব্লুপ্রিন্ট রয়েছে অভিজিতের খাতায়। আর বাকি সদস্যরা যেমন বলা হচ্ছে তেমন ভাবে কাজে লেগে পড়ছে। প্রথমেই সামুয়েল ঠিক করে, স্কুল বন্ধ এদের এখন, তাই একটা অস্থায়ী স্কুল বানাবে। যেখানে সে স্প্যানিশ শেখাবে বাচ্চাদের। ওদের শেখার উৎসাহ দেখেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। আর সেও শিখে নেবে স্প্যানিশের অসমিয়া শব্দের প্রতিরূপ। এর জন্য অভিজিতদের গোয়ালঘরটিই প্রাথমিক ভাবে নির্বাচন করা হয়েছে। কাল থেকেই চালু হবে তাদের স্কুল। সকাল সাতটা থেকে দশটা স্কুলের সময়। এই তিনঘন্টায় ছেলেমেয়েদের জন্য জলখাবারের ব্যবস্থা করবে অভিজিতদের যৌথ রান্নাঘর। আপাতত খর্চা যোগানের দায়িত্ব এই পরিবার তুলে নিয়েছে। এরপর অন্য কেউ সাহায্য করতে চাইলে, নেওয়া হবে।

এই পরিকল্পনা প্রত্যকে বাড়ি ঘুরে ঘুরে জানানো হল পরের দিন। বেশিরভাগ পরিবারই রাজি। সম্পন্ন পরিবার যারা আছে, তারা নিজেরাই যেচে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিল। কয়েক ঘর অবশ্য সব শুনল, মুখে কিছু বলল না। জোর খাটানোর কোনো চিন্তাভাবনাই এদের নেই, সামুয়েলের ব্যস্ততায় সময় কেটে যাবে, ছেলেমেয়েগুলোরও একঘেয়েমি কাটবে। শিক্ষাও হবে কিছু—এই হল উদ্দেশ্য। পরের দিন সকালে বুলবুলের ছজন সঙ্গীরা তো এসেছেই, আরও বারোজন এসে উপস্থিত হল। সকলকে নিজের নিজের আসন, খাতা, পেন নিয়ে আসতে বলা হয়েছিল। এখানের মেয়ে, বউরা বাড়িতেই চমৎকার আসন বোনে। ফলে আসনের অভাব কারুরই নেই, কিন্তু বাড়তি খাতা কেউ কেউ আনতে পারেনি। তবে স্লেট, পেন্সিল সকলেই এনেছে না বলতেই। সামুয়েল স্লেট পেনসিল নিয়েই শুরু করল আজ। একজনের স্লেটে স্প্যানিশের প্রথম বর্ণ লিখে দিল। সেই অনুসারে কপি করতে থাকল সবাই। যেহেতু এরা বড় হয়েছে কিছুটা, তাই খুব বেশি দেরি হল না প্রাথমিক বর্ণ শিক্ষায়। কিছুক্ষণ লেখালেখির পর্বের পরে এবারে সামুয়েল কিছু চলতি শব্দের স্প্যানিশ প্রতিশব্দ শেখাতে শুরু করল ওদের। এই মৌখিক পর্বটা সবথেকে বেশি উপভোগ করল ওরা। মাঝখানে মুড়ি আর আলু, ছোলার তরকারি দিয়ে টিফিন পর্বও মিটে গেল সুন্দর ভাবে। আপাতত সময় শেষ। কাল আবার স্কুলে আসবে ওরা। উৎসাহে, আনন্দে ফুটছিল বাচ্চাগুলো। মনপ্রাণ ভরে উঠছিল সামুয়েলেরও। ওরা চলে গেলে গান ধরল সে-


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন