সোমবার, ২১ জুন, ২০২১

মানসী গাঙ্গুলী

                                                    




কিশলয়


     যতদূর চোখ যায় আকাশটা ঘোর কালো রঙ ধরেছে, বৃষ্টি এল বলে। জানলা দিয়ে সেইদিকে তাকিয়ে নগেনের মনটা আজ হারিয়ে যাচ্ছে বারেবারে। ওর একটা অফিসঘর আছে, যেখানে বড় পর্দায় ষোলটা সিসি ক্যামেরায় নজর রাখে সারাক্ষণ ৪০ বিঘা নার্সারির চারিদিকে। তার স্বপ্নের নার্সারি।  এছাড়া পাশে একটা বড় ঘর। নানানরকমের সার বিভিন্ন গাছে দেবার জন্য, গাছের পোকা মারার ওষুধ, বিভিন্ন গাছের বাল্ব বস্তাবন্দি হয়ে সব ওই ঘরে আশ্রয় পেয়েছে। পাশে আরও একটা ঘর, সেখানে নানানরকম সৌখিন টব, ইনডোর প্ল্যান্ট রাখার স্ট্যান্ড, ছোট-বড়, গাছে জল দেবার রকমারি ঝাঁঝরি, গাছ ছাঁটাই করার কাঁচি, শাবল, কোঁদাল, কুড়ুল, খুরপি, কাস্তে, মানে গাছপালা করতে আনুষঙ্গিক যা যা প্রয়োজন সবই রয়েছে তার জিম্মায়। খদ্দেরকে যাতে শখের বাগান করতে এখানে সেখানে ছুটোছুটি না করতে হয়, একই ছাদের নিচে দাঁড়িয়ে সবই যাতে তারা সহজে পেয়ে যায়। আরেকটা অপেক্ষাকৃত ছোট ঘর, ছোটখাটো কিচেনই বলা যায়। সেখানে চায়ের সরঞ্জাম, একোয়া গার্ড, জলের বোতল, একটা ফ্রিজ, কিছু গ্লাস, প্লেট, চায়ের কাপ-প্লেট, এছাড়া হাঁড়ি, কড়াও রয়েছে, কখন কি প্রয়োজন হয় সেইজন্য। সামনে অনেকটা চত্বর ছাউনি করা। খদ্দের গাড়ি নিয়ে এলে, পার্ক করে নামলেই ছাউনির তলায় এসে যাবে, রোদবৃষ্টি স্পর্শ করবে না তাদের। ছাউনির নিচে অফিসঘরের ঠিক সামনে একটা টেবিল পাতা ও বেশ কয়েকটা চেয়ার। সম্মানীয় অনেক ব্যক্তিত্বই এই নার্সারিতে আসা-যাওয়া করেন প্রায়শঃই। তাদের সেখানে চা পরিবেশন করা হয়। নগেনের এখন বিরাট পরিচিতি। এলাকার সব থেকে বড় নার্সারি তার এই কিশলয়, কত বড় বড় মানুষের সঙ্গে তার ওঠাবসা এই গাছের খাতিরে। গ্রামের চাষির ঘরের ছেলে ১২ ক্লাস পাস করার পর বাবা বললেন, "আর পড়াতে পারব না বাবা, এবার আমার সঙ্গে ক্ষেতে কাজ করবি চল। আমার বয়স হচ্ছে, একা একা আর পেরেও উঠি না, তুই পাশে থাকলে বড় সুবিধা হয়"। পড়াশুনার ওখানেই ইতি নগেনের।
         অফিসঘরে নিজের টেবিলে বসে কিছু জার্নাল নাড়াচাড়া করতে করতে আকাশের দিকে চোখ যায় নগেনের। রিভলভিং চেয়ারটা ঘুরিয়ে উঠে পড়ে সে। পায়ে পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পুকুরের পাশের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে। ডানদিকে জমিতে ভাগ ভাগ করে কোথাও গোলাপ, কোথাও রংবেরঙের একপাটি জবা, কোথাও পঞ্চমুখী জবারা সব বাগান আলো করে রেখেছে। এরা নগেনের প্রাণ।  নগেনের যাবার সময় দুলে দুলে যেন তারা অভিবাদন জানায় তাকে। কতটুকুই বা সম্বল ছিল তার শুরুতে। বাবার সঙ্গে ক্ষেতে কাজ করার সময় মাটি চিনতে শুরু করল সে। কোন মাটিতে কি ধরনের গাছ ভাল হয়, কোন মাটি কতটা জল চায়, এরকম চাষের নানান কথা। বাবা নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে থাকেন। নগেন বুঝতে পারে, এই অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষাই হল আসল শিক্ষা। এই শিক্ষা পুঁথিগত শিক্ষার থেকে অনেক জোরদার। কিন্তু এও বুঝল, সে মাঠে এভাবে বাবার সঙ্গে ঘুরে চাষবাসকেই জীবিকা করে নিলে বাবার মতোই ছাপোষা হয়ে থাকতে হবে তাকে আজীবন। তাহলে ভবিষ্যতে সেও তার ছেলের পড়ার খরচ জোগাতে পারবে না। না, এমন জীবন সে চায় না। টাকার অভাবে যখন তার পড়া বন্ধ হয়েছিল, কষ্ট হয়েছিল তার। খুব মেধাবী না হলেও আরও বেশ কিছুদুর এগোতে পারত হয়ত সুযোগ পেলে। বন্ধুরা শহরে গিয়ে কলেজে ভর্তি হলে বুকটা বেদনায় ভার হয়ে গিয়েছিল তার, যা ও বাবাকে বুঝতে দেয়নি সেদিন। কিন্তু এবার যে বাবাকে কিছু কথা বলা বিশেষ প্রয়োজন। মনের মধ্যে  কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে কিছুদিন থেকে যা ও বাবাকে খুলে বলতে পারছে না পাছে তিনি ব্যথা পান মনে। কিন্তু এভাবে সময় নষ্ট করে লাভ নেই, বাবাকে বলতেই হবে। তার জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিতে লাগল নগেন যাতে বাবা বুঝতে পারেন তার পরিকল্পনা, অযথা দুঃখ না পান মনে।
         বলি বলি করেও বলতে পারে না বাবাকে। বাবা রোজই ছেলেকে ক্ষেতে নিয়ে গিয়ে চাষবাস শেখাতে থাকেন, বলার সুযোগ আর হয় না। সুযোগ এল অবশেষে। একদিন নগেনের এক বন্ধু বীরেন, ওদের গ্রামেরই ছেলে, কলকাতায় হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে, নামী কলেজে পড়ে, এল ওদের বাড়ি। অনেকদিন পর বন্ধুর সঙ্গে দুটো গল্পগুজব করার ইচ্ছা। সেই সময় বাবা নগেনকে ডাকতে থাকেন ক্ষেতে নিয়ে যাবেন বলে। বীরেনকে দেখে ওর বাবা কুশল সংবাদ নেন আর একথা সেকথায় ওর কলকাতায় পড়াশোনার কথা জানতে পারেন। তিনি বীরেনের সামনেই দুঃখ করেন ছেলেকে আর পড়াতে না পারার জন্য। পরিবেশটা থমথমে হয়ে যায়। বীরেন বুঝতে পারে ও ভুল সময়ে এসে পড়েছে, ওর জন্য ওদের কাজের দেরী হয়ে যাচ্ছে। তাই, "আজ আসি রে" বলে উঠে পড়ে। ক্ষেতে যাবার পথে নগেনের বাবা বারেবারে বিলাপ করতে থাকেন, "আমি তোর অপদার্থ বাবা, তোকে একটু পড়াশোনা করানোর ক্ষমতাও আমার নেই। বীরেন কেমন সুন্দর কলেজে পড়ছে। আজ আমার সামর্থ থাকলে তুইও কলেজে যেতিস।" নগেন কী করে বাবাকে চুপ করাবে ভেবে পায় না। বলে, "বাবা, তুমি যে কত ভালোবাসা দিয়ে আমায় হাতে-কলমে কাজ শেখাচ্ছ এটাই বা কম কী?" বাবার মন ভোলে না তাতে। চোখে তাঁর জল এসে যায়। চোখের জল মুছে বলেন, "তুই আমার বড় ভাল ছেলে রে, তাই আমার অক্ষমতাকে ঢাকবার জন্য এমন কথা বলছিস"। নগেন বলে, "বাবা অনেকদিন থেকেই তোমায় দুটো কথা বলব, বলেও বলতে পারছি না, পাছে তুমি মনে কষ্ট পাও। আজ ভাবছি কথাগুলো বলা বড় দরকার। আজ তুমি আমায় পড়াতে পারছ না বলে মনে যে কষ্ট পাচ্ছ, আমিও যদি এই চাষবাস নিয়ে পড়ে থাকি, ভবিষ্যতে আমাকেও তোমার মত এমন মনোকষ্টে ভুগতে হবে। চাষবাস করে আমিও আমার সন্তানদের পড়ার খরচ জোগাতে পারব না, তাই আমাকে অন্য কিছু ভাবতে হবে। ক'দিন থেকেই আমার মাথায় একটা কথা ঘুরছে। চাষবাস যেমন চলছে চলুক, আমি যতটা পারি তোমার সঙ্গে থাকব, প্রয়োজনে দু'একটা লোক রাখব, জানি তাতে তাদের রোজ দিয়ে আমাদের রোজগারে টান পড়বে, কিন্তু বাবা আমার ওপর ভরসা রাখো। কিছুদিন কষ্টেসৃষ্টে চালিয়ে নাও, আমার বিশ্বাস আমি তোমাদের সুখের মুখ দেখাতে পারব। তুমি আমায় চারশোটা টাকা দাও, আমি একটা জমি দেখে রেখেছি, সেটা কিনব। সেখানে আমি একটা নার্সারি করব। আজকাল মানুষের মধ্যে ফুল-ফলের গাছ লাগানোর একটা বেশ ঝোঁক এসেছে, সেটাই আমার মূলধন। এই নার্সারি সাজিয়ে-গুছিয়ে তুলতে যেটুকু সময়, তারপর আমার বিশ্বাস এই নার্সারি আমাদের সুখের মুখ দেখাবে।"
          বাবা হাঁ করে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে তার কথাগুলো শোনেন অবাক বিস্ময়ে। এ জীবনে সুখের মুখ তিনি দেখেননি। উদয়াস্ত পরিশ্রম করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দুটো পেটের জোগাড় কোনরকমে করতেই তিনি হিমসিম খেয়েছেন।  তার পেটের তাগিদে লড়াই জারি রয়েছে আজও। ছেলের কথাগুলো উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন তিনি। মনে মনে ভাবেন,  "ছেলের পেটে দু'কলম বিদ্যে রয়েছে বলে সে এভাবে ভাবতে পারছে। কই আমি তো এমন অন্য কিছুর কথা ভাবতেও পারিনি কোনোদিন! বাপ-ঠাকুরদাদার মত চাষবাস নিয়েই পড়ে আছি, এর বাইরে কিছু করতে পারি তা কখনও ভাবনায় আসেনি। তবে ছেলে যখন চাইছে করুক, আমার তরফ থেকে যতটা সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করব"। কিন্তু কিভাবে যে সাহায্য করবেন তা তার মাথায় আসে না। সে আমলে গরিব চাষির ঘরে এক কথায় চারশো টাকা বের করে দেওয়া বড় সহজ ছিল না। মুশকিল আসান হয়ে পাশে দাঁড়ালেন মা।  ছেলের স্বপ্ন চরিতার্থ করতে মা এতদিন আগলে রাখা তাঁর বিয়ের কাঁসার দানের বাসন বিক্রি করে, তাতে কষ্ট করে জমিয়ে রাখা লক্ষীর ভান্ডারের পয়সা মিলিয়ে চারশো টাকার ব্যবস্থা করে দিলেন।
           শুরু হল নগেনের নার্সারি। প্রথমে নিজে হাতে কাজ করত। লোক রাখবার, তাকে রোজ দেবার ক্ষমতা ছিল না। সকাল থেকে গাঁইতি, কোঁদাল চালিয়ে মাটি আলগা করে বিভিন্ন জায়গায় কোথাও পেঁপের বীজ কোথাও আমের আঁটি কোথাও নারকেল আবার কোথাও বা বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করা রঙবেরঙের জবা গাছের ডাল বসানো, রকমারি পাতাবাহারের ডাল সংগ্রহ করে চারা তৈরি করা শুরু হল। চাষবাসের জ্ঞান যা তৈরি হয়েছে তার ওপর নির্ভর করেই চলতে লাগল তার নার্সারি তৈরি। বড় যত্ন নিয়ে সে কাজ করে যদিও ফুল-ফল গাছ তৈরির জ্ঞান তার তেমন নেই, কেবল আছে অসম্ভব মনের জোর, আছে উদ্যম, আছে পরিশ্রম করার ক্ষমতা। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনোভাব তার, 'কিছু আমি করবই'। ছোট ছোট ডালগুলো যখন শিকড় দিয়ে মাটি আঁকড়ে ধরে, কচি কচি পাতা গজায় ডালের আগায়, খুশিতে নগেনের চোখ ঝলমল করে ওঠে। যখন বীজ থেকে অঙ্কুরোদগম হয়ে সবুজ উঁকি মারে মাটির ওপরে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় সে, ওইদিকে তাকিয়েই যেন তার দিন কাটে। এইভাবে একটু একটু করে ভরে ওঠে তার নার্সারি। নাম দেয় কিশলয়। দিনান্তে বেশিরভাগ সময় পড়ে থাকে ও কিশলয়ে। পাশেই আছে একটা পুকুর, সেখান থেকে জল তুলে গাছে জল দেয়। কত জায়গায় ছুটে গাছ সংগ্রহ করে, বিভিন্ন নার্সারি ঘুরে ঘুরে শেখে গাছেদের পরিচর্যা। পুঁথিগত কোনও শিক্ষা যে তার নেই, সবই হাতে-কলমে। সেই ছোট্ট কিশলয় আজ বিঘা বিঘা জমি নিয়ে বিস্তৃত। পাশের সেই পুকুরটাও এখন তার কিশলয়ের অন্তর্গত। পুকুরের চারপাশে ঘিরে রয়েছে নারকেল গাছের সারি। যতদূর চোখ যায় সবুজ, সবুজ আর সবুজ। ঐ সবুজের ঘেরাটোপে সারাদিন কাটায় ও মনের আনন্দে। বাড়িও ওকে তেমন টানে না। এ মাটির টান, সবুজের টান তার সাংঘাতিক। এদের ভালবেসেই জীবনে আজ সে প্রতিষ্ঠিত। অল ইন্ডিয়া নার্সারি অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এখন সে। কত দেশ-বিদেশ ঘুরেছে এই গাছ নিয়ে, গাছের ওপর বিভিন্ন সেমিনারে সে কত বক্তব্যও রেখেছে দেশে বিদেশে। একটুকরো বিদেশকে এনে ফেলেছে সে তার কিশলয়ে। বিভিন্ন দেশের নানারকম গাছ এনে আমাদের দেশের জলবায়ুতে, আমাদের দেশের মাটিতে তা কেমন হয় সেইসব তার এখন গবেষণার বিষয়।
            অতীত রোমন্থন করতে করতে অনেকদূর পৌঁছে গেছে সে। টিপটিপ করে বৃষ্টি হতে হতে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এসে আদ্যপ্রান্ত ভিজিয়ে দেয় তাকে। মনের সুখে ভিজছে নগেন। অনেকদিন প্রখর রোদের পর বৃষ্টি এল। নগেন ভিজছে আর দেখছে তার কিশলয়ের গাছপালারা কেমন তার সঙ্গে মহাসুখে বৃষ্টিস্নান করছে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন