বৃষ্টির আকাশ...।।
আজ তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছে বৃষ্টি। সব কাজ সেরে বিছানায় শুয়ে সবে চোখ বুজেছে, টুং শব্দ শুনে মোবাইলের দিকে তাকাতেই ইন্দ্রের ম্যাসেজটা দেখতে পেল। দিনটির কথা ভোলেনি ইন্দ্র। ম্যাসেজ আসার পর থেকে সারারাত ঘুম আসেনি বৃষ্টির। প্রতিবছরের মতো গত বছরেও এই দিনটায় বাবা ভোরে উঠে খাটাল থেকে দুধ নিয়ে এসে নিজের হাতে পায়েস বানিয়েছেন। মা চলে যাওয়ার পর বাবা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন মায়ের অভাব যেন টের না পায় দুই বোন।
হাতমুখ ধুয়ে, স্নান করে গতবছরে বাবার দেওয়া নতুন শাড়িটা পরল বৃষ্টি। শাড়িটার সঙ্গে যেন বাবার স্নেহ, মমতা জড়িয়ে আছে। মনে হলো পাশেপাশে বাবা কোথাও আছেন। এই বুঝি ডাক দিলেন তাকে...বৃষ্টি’মা...।
এককাপ লাল চা নিয়ে খোলা জানলার কাছে চেয়ারে এসে বসল বৃষ্টি। খুব প্রিয় এই জানলাটি। বাড়িতে থাকলে একমাত্র এই জানলা দিয়েই আকাশ দেখতে পায় সে। আকাশের দিকে একবার তাকাল বৃষ্টি। আকাশটা তার মতোই মনমরা, তমসাচ্ছন্ন, সূর্যদেবের যেন ঘুম ভাঙ্গে নি এখনো। গুমোট গরম, এই সাত সকালেই বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে কপালে। মৌসুমি বায়ু এসে পড়েছে, বর্ষা আসতে শুধু সময়ের অপেক্ষা, জানিয়েছে আবহাওয়া দপ্তর।
শহরতলীতে দুই কামরার টালির ছাদ দেওয়া ছোট্ট বাড়িতে একাই থাকে বৃষ্টি। প্রথম দিকে নানান ধরণের অসুবিধা হলেও এখন একা থাকার অভ্যাস হয়ে গেছে। একা সোমত্ত মেয়ের যা হয় আর কি। উপকার করার আছিলায় কাছে আসার চেষ্টা লেগেই ছিল বেশ কিছুদিন। ইন্দ্রের যাতায়াতের পর থেকে ধারে কাছে ঘেঁসে নি কেউ। একবছর আগে যখন বৃষ্টি প্রায় ভেঙ্গে পড়েছিল, তখন ইন্দ্র এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে সাহস জুগিয়ে। আত্মীয় পরিজন চলে যাওয়ার পর বেশ কয়েকটা দিন দুইবেলা আসতো ইন্দ্র। পুরো নাম ইন্দ্রজিৎ সেন, বছর তিরিশের তরুণ পুলিশ ইন্সপেক্টর। না, বৃষ্টি কোনো রকম বেচাল দেখেনি তার মধ্যে।
ঘটনার দিন স্থানীয় থানা থেকে সাব-ইন্সপেক্টর ইন্দ্রজিৎ এসেছিল ইন্সপেকশন করতে। সেই কারণে বার কয়েক বৃষ্টির কাছে আসতে হয়েছিল তাকে, বডি নিয়ে যাওয়া, পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজনদের কাছে জিজ্ঞাসাবাদ ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়ার পর বৃষ্টির অসহায়ত্বতা দেখে আগ বাড়িয়ে শ্মশানযাত্রার যাবতীয় কাজে সঙ্গে ছিল ইন্দ্র। দেহ চুল্লীতে দেওয়ার সময় বিপর্যস্ত বৃষ্টি ইন্দ্রের হাত আঁকড়ে ধরেছিল। সেই শুরু...। তারপর থেকেই ক্রমে পরস্পর কাছাকাছি এসেছে তারা। প্রকৃতপক্ষে ইন্দ্রের সাহচর্যেই উঠে দাঁড়িয়েছে বৃষ্টি।
বৃষ্টি আর মেঘা দুই বোন। বৃষ্টি বছর পাঁচেকের বড়। বাবা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। একসময়ে রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিলেন। আদর্শচ্যুত হননি কোনোদিন। এলাকায় মানুষজন সম্মান করেন তাঁকে। মা মারা গেছেন মেঘার জন্মের সময়। বাবা প্রতিষ্ঠানের সামান্য বেতনে দুই মেয়েকে অনেক কষ্টে নিজের মনোমত বড় করার চেষ্টা করেছেন।
কলেজের পাঠ চুকিয়ে একটা প্রাইভেট স্কুলে চাকরী পেয়ে যায় বৃষ্টি। বেতন সামান্যই, তবু তাঁর চাকরী পাওয়ায় সংসারে একটু স্বচ্ছলতা এসেছিল। ছোট বোন মেঘা স্থানীয় কলেজে অ্যাডমিশন নেওয়ার পর থেকে ক্রমাগত চাহিদা বাড়তে থাকে। আর তার চাহিদা মতো অর্থের জোগান মেটাতে হতো বৃষ্টিকে। মেঘার এই বিলাসিতা ভালো না লাগলেও যতটা সম্ভব ছোট বোনের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করত বৃষ্টি। এই ব্যপারটাতে বাবাকে জড়াতে চায় নি। ভেবেছিল কলেজে উঠলে অনেকেরই প্রথম প্রথম খরচের বহর বাড়ে। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে সব। সকলে তো আর বৃষ্টি নয়। অভাবের সংসারে সেই সুযোগও ছিল না বৃষ্টির। মেঘার তো দিদি আছে...।
কলেজে দ্বিতীয় বছরে মেঘা চালচলনে পরিবর্তন লক্ষ করল বৃষ্টি। তার পোশাকআশাক, সাজগোজের বহর, সব কিছুই যেন অদ্ভুত হালফ্যাসানের, যা কোনোদিন বৃষ্টি চিন্তাই করেনি। ক্রমে টাকাপয়সার চাওয়া মাত্রাতিক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একদিন এই নিয়ে প্রশ্ন করায় রীতিমত অপমানিত হতে হয়েছিল বৃষ্টিকে। সেই অপমান নিরবে হজম করে পরের দিন স্কুলে যাওয়ার সময় মেঘাকে হাত খরচের কিছু টাকা দিতে গেলে বলেছিল; “আমার হাত খরচের টাকা আমি নিজেই জোগার করে নেব, তোকে আর এই নিয়ে ভাবতে হবে না”। সেদিন চোখের জল লুকোতে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল বৃষ্টি।
অনেকবার ভেবেছিল সব কথা বাবাকে বলবে। কিন্তু কয়েকবার বলতে গিয়েও বলতে পারেন নি বৃষ্টি। প্রতিষ্ঠানের কাজ সেরে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যেত বাবার। তাই বাবাকে না জড়িয়ে সব অপমান দূরে সরিয়ে মেঘাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু তার ফল হয়েছিল বিপরীত। এবিষয়ে কিছু বলতে গেলে উন্মত্ত হয়ে উঠত মেঘা। তার অস্বাভাবিক আচরণের ফলে ভয়ঙ্কর ঘটনার আশঙ্কায় চুপ করে থাকতে হয়েছে বৃষ্টিকে।
একদিন রাতে রান্নাবান্না সেরে মেঘার জন্য অপেক্ষা করছে, বাবার ফিল্ড ডিউটি, ফিরতে দেরী হবে। এদিকে রাত প্রায় ন’টা বাজে। মেঘার দেখা নেই। এই সময় যদি বাবা ফিরে আসে, কী জবাব দেবে বাবাকে। এই দুশ্চিন্তায় নিয়ে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল বৃষ্টি...।
হঠাৎ একটা গাড়ির আলো চোখে এসে লাগল বৃষ্টির। একটা প্রাইভেট কার এসে দাঁড়াল বাড়ির সামনে। প্রাইভেট কারের পেছনের সিট থেকে নামল মেঘা। বৃষ্টি দরজা খুলে দিতেই পা থেকে জুতো জোড়া একপাশে ছুঁড়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। বৃষ্টি এসে মেঘার জামা কাপড় পাল্টে দেওয়ার সময় একটা কটু গন্ধ নাকে লেগেছিল। সেই রাতে মেঘা কথা বলার মতো অবস্থায় ছিল না। পরের দিন সকালে প্রশ্ন করায় মেঘা জানিয়েছিল, এক ফিল্মের প্রডিউসার তাকে লিফট দিয়েছে। তারপর থেকে প্রায়ই কোনও না কোনও গাড়ী এসেছে তাকে নামিয়ে দিতে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করতে চরম লাঞ্ছনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল বৃষ্টিকে। না, আর নয় বাবাকে খুলে বলা দরকার। সকালে মেঘা কলেজে চলে যাওয়ার পর সব কথা বাবাকে খুলে বলে বৃষ্টি। বৃষ্টির কথা শোনার পর বাবা কোনও কথা বলেন নি। থমথমে মুখে কাজে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।
সেদিন বাবা একটু আগে আগেই ফিরেছিলেন কাজ থেকে। ফিরে এসে বলেছিলেন, মেঘা ফিরলে তাঁর ঘরে পাঠিয়ে দিতে। রাত আটটা নাগাদ ফিরেছিল মেঘা। আসার সাথে সাথে তাকে কথামত বাবার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিল বৃষ্টি। মেঘা বাবার ঘরে দিকে পা বাড়াতে সেও পিছু নিয়েছিল তার। আসন্ন উদ্ভূত পরিস্থিতির কথা ভেবে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল।
মেঘা ঢোকা মাত্র বাবা দরজাটা বন্ধ করে দিতে বললেন মেঘাকে। বাইরে থেকে কান পেতে ছিল বৃষ্টি। বাবা খুব শান্ত ভাবেই বিস্তারিত জানতে চাইলেন মেঘার কাছে। বাবার কথাটা শোনা মাত্র উত্তেজিত হয়ে উঠল মেঘা। মেঘার কথায় বাবা আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না, চিৎকার করে উঠলেন। তর্কাতর্কি চরম জায়গায় পৌঁছাতে বাবার শরীরের কথা ভেবে বৃষ্টি আর বাইরে থাকতে পারল না। সজোরে দরজায় ধাক্কা দিল। দরজা খোলার আগে শুনতে পেল, মেঘা উন্মত্তের মতো বলছে; “আমি অ্যাডাল্ট, আমার জীবন কিভাবে চলবে তা আমিই ঠিক করব। তোমাদের মত নোংরা বস্তিতে আমি থাকতে পারব না। তোমরা আদর্শ ধুয়ে জল খাও...। আমাকে আমার মতোই চলতে দাও...”।
“তুই বেরিয়ে যা, এই বাড়িতে থেকে এসব চলবে না”। আর কথা বলতে পারলেন না বাবা, বিছানায় এলিয়ে পড়ছিলেন, দৌড়ে গিয়ে শুইয়ে দিয়েছিল বৃষ্টি। সশব্দে দরজা ধাক্কা বেরিয়ে গিয়েছিল মেঘা।
সেরাত্রে অনেক চেষ্টা করেও কাউকে খাওয়াতে পারে নি বৃষ্টি। বাবার মাথায় হাত বোলানোর সময় বৃষ্টির হাত চেপে ধরে বলেছিলেন; “আমি হেরে গেলাম রে মা...”। ভোর রাত্রে বিছানার পাশে মেঘাকে না পেয়ে সারা বাড়ি খুঁজেছিল বৃষ্টি। কোথাও পায়ই তাকে। এই ভোরে কোথায় গেছে মেঘা...? মেঘার জন্য দুশ্চিন্তায় আর ঘুম এলো না বৃষ্টির...। বেলা বাড়তে চা আর দুটো বিস্কুট নিয়ে বাবার দরজায় ধাক্কা দিল বৃষ্টি। বারবার ধাক্কা দিয়ে সাড়া না পেয়ে উৎকণ্ঠায় চীৎকার করে উঠেছিল। তার চীৎকারে আশেপাশের লোকজন এসে দরজা ভাঙ্গতে ঝুলন্ত দেহ দেখতে পায় বাবার। এই ঘটনার পর মেঘাকে আর খুঁজে পায় নি বৃষ্টি।
আনমনা হয়ে ভাবছিল বৃষ্টি। আজও বাবাকে মাপ করতে পারে না। বাবা আত্মহত্যাকে ঘৃণা করতেন, বলতেন; আত্মহত্যা পালিয়ে যাওয়ারই নামান্তর। সেই বাবা কিনা আমাকে একা রেখে পালিয়ে গেলেন ! একবারও ভাবলেন না তার কথা ! ছোট বোন মেঘা আজ কোথায়...। তারও কি দিদির কথা মনে পড়ে না? তাকে খুঁজতে তো কম চেষ্টা করে নি সে!
ভাবতে ভাবতে হারিয়ে গিয়েছিল বৃষ্টি। একটানা দরজায় কড়ানাড়ার শব্দে সম্বিৎ ফিরে পেল। দরজা খুলতেই দেখল, হাসিমুখে টিফিন ক্যারিয়ার হাতে ইন্দ্র। ব্লু জিন্সের ওপর কলার দেওয়া সাদা পাঞ্জাবীতে একদম অন্যরকম লাগছিল ইন্দ্রকে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল বৃষ্টি। “হ্যাপি বার্থডে”... বৃষ্টির থুতনি টিপে আদর করে কপালে চুম্বন এঁকে দিল ইন্দ্র। মুখ তুলতেই ইন্দ্র দেখল, বৃষ্টির চোখ থেকে নেমে আসছে অশ্রুধারা। বৃষ্টিকে একহাত দিয়ে জড়িয়ে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল ইন্দ্র। তারপর চেয়ারে বসিয়ে বৃষ্টির সামনে একটা টুল টেনে নিয়ে বসে পড়ল। টিফিন ক্যারিয়ার খুলে চামচে করে মুখে তুলে দিলো সঙ্গে আনা পায়েস। এমনই করেই বাবা খাইয়ে দিত তাকে। আর থাকতে পারলো না বৃষ্টি। বাঁধ ভাঙ্গা বন্যার মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল বৃষ্টি। উঠে দাঁড়িয়ে কাছে টেনে নিল ইন্দ্র...। কাঁদুক...কাঁদুক, হালকা করুক নিজেকে। মেঘের গুরু গুরু গর্জনে জানলা দিকে তাকাল ইন্দ্র। চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসছে...। এক্ষুনি বর্ষা নামল বলে।
“জানো, মা আজ ডেকেছে তোমাকে। ওখানেই আমরা সবাই সেলিব্রেশন করব। রেডি হয়ে নাও”। চোখ মুছে হাসল বৃষ্টি। আর তক্ষুনি বিদ্যুতের ঝলকানির সাথে অঝোর ধারায় নামল বর্ষা...।
#
বৃষ্টির কাছ থেকে মেঘার ছবি আর বিবরণ নিয়ে প্রায় এক বছর খোঁজ করেছে ইন্দ্র। গতকাল রাত্রে পার্ক্সট্রিট থানার একই ব্যাচের এক বন্ধু জানিয়েছে, চেহারার বর্ণনা অনুযায়ী একটি মেয়েকে পাওয়া গেছে। পার্ক স্ট্রীটের একটা হোটেল থেকে কয়েকটি মেয়ের সাথে তাকে এরেস্ট করা হয়েছে। অবশ্য তার নাম মেঘা নয়, ‘ম্যাডোনা’। কলকাতায় ব্যবসায়ী মহলে বেশ পরিচিত সে। একজন নাম করা কলগার্ল তথা পর্ণস্টার। আগামীকাল পার্ক স্ট্রীটে যাবে ইন্দ্র। একবার ইন্টারোগেট করলে সব বোঝা যাবে। না, এখন এসব কথা বলা যাবে না বৃষ্টিকে...।
গল্পটা আমার খুব ভালো লাগল
উত্তরমুছুনএমন গল্প আরও পড়তে চাই