নবম পর্বের পর
খোঁজ
(১০)
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সিনিয়র ডিপ্লোমা পরীক্ষাটা আর দেওয়া হল না শর্মিলার l সেজন্য উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডী পেরোনো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে l উচ্চ মাধ্যমিকের পড়া, টিউশন সব সামলে গানের ক্লাস, রেওয়াজ সবকিছুতেই বেশ ফাঁক থেকে যাচ্ছিল l অগত্যা গানের স্কুল ছাড়তে বাধ্য হল শর্মিলা l গান শেখা একেবারে বন্ধ হয়ে যাক এটা অপর্ণা চাইছিলেন না l তিনি রবিঠাকুরের গানে নিবেদিতপ্রাণ, একনিষ্ঠ শ্রোতা l তাঁর মেয়ে হয়ে শর্মিলা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখবে না ! প্রধানত মায়ের ইচ্ছেতেই শর্মিলা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী দময়ন্তী মুখোপাধ্যায়ের স্পেশাল ক্লাসে ভর্তি হল l বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে তাঁর বাড়ি l প্রতি রবিবার সকালে শর্মিলা একা একাই বাসে করে গানের ক্লাসে যাওয়ার অনুমতি পেল l এই প্রথম বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে একা বেরোনো, তার উত্তেজনাই আলাদা l একা বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে ওঠা, নিজে নিজে টিকিট কাটা l হঠাৎই যেন অনেকটা বড় হয়ে গেল শর্মিলা l মৌলালি থেকে ঋতু নামে একটি মেয়েও ওই ব্যাচে গান শেখে l সে অবশ্য অনেকটাই বড় l ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে বাংলায় এম এ ফাইনাল ইয়ারে পড়ে l কোনো কোনোদিন যাওয়ার সময় বাসে ঋতুদির সঙ্গে দেখা হয়ে যেত l ফেরার সময় দুজনেই এক বাসে ফিরত l ঋতু সঙ্গী হওয়াতে অপর্ণাও খানিকটা নিশ্চিন্ত হলেন l যদিও শর্মিলা অনেকটা বড় হয়েছে, কিন্তু সেটা মাকে বোঝানোর সাধ্য ওর নেই l অপর্ণার কাছে মুন্নি আর মুনমুনের তেমন কোনো ফারাক নেই l
ঋতুদির বয়ফ্রেন্ডের নাম স্বপ্নদীপ রায়চৌধুরী l ওদের পাড়াতেই থাকে l সে একজন কবি l বাংলায় এম এ পাশ করে টিউশন করে আর কবিতা লেখে l বিভিন্ন নামকরা কাগজে তাঁর লেখা ছাপা হয় l শর্মিলাও পড়েছে, তবে আধুনিক কবিতা একেবারেই মাথায় ঢোকে না ওর l ঋতুদি স্বপ্নদীপকে নিয়ে গর্বিত হলেও সম্পর্কটার ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান l স্বপ্নদীপ কোনো স্থায়ী চাকরিবাকরির চেষ্টা করে না l বাউন্ডুলেপনা করে বেড়ায় বলে নিজের বাড়িতেও কোনঠাসা l এমন ছেলের সঙ্গে ঋতুদির বাড়ি থেকে বিয়ে দিতে চাইবেই বা কেন ! গানের ক্লাসে যাওয়া আসার পথে শর্মিলার এসব কথা প্রায় সবই জানা হয়ে গেল l রিজ্জুদার কথাও অবশ্য জানত ঋতুদি l ধ্রুবর ব্যাপারটাও বলেছিল l বেশ জমে উঠেছিল ওদের অসমবয়েসী বন্ধুত্ব l ঋতুদি একদিন হাসতে হাসতে বলেছিল
--রিজওয়ানের সঙ্গে তো তোর মাসে একবার মাত্র দেখা হয় l ধ্রুব বেচারা কি দোষ করল ! তুই ইচ্ছে করলে ওকে একটু সময় দিতেই পারতিস l তোরও সময় কাটত, ওকেও বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হত না l
-- কি যে তুমি বল না ঋতুদি ! আমি জেনেশুনে একটা ছেলের সঙ্গে ফ্লার্ট করব ! ধ্রুব এখন খুব মন দিয়েই পড়াশোনা করছে l নতুন স্কুলে ইলেভেন থেকে টুয়েলভে উঠতে ফার্স্ট হয়েছে l ওখানে গিয়ে ওর ভালোই হয়েছে l
সেদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি l ক্লাসের শেষে ছাতা মাথায় দিয়ে দময়ন্তীদির বাড়ি থেকে বেরিয়েই বিপদে পড়ল ওরা l হাওয়ার তোড়ে ছাতা উল্টে প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে চপচপে হয়ে কোনোরকমে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছল l বাসস্ট্যান্ডে শেডের নিচে স্বপ্নদীপদা দাঁড়িয়েছিল l ঋতুদিকে বলল
---গড়িয়াহাটে সুনীলদার কাছে এসেছিলাম l ভাবলাম তোমার তো আজ গানের ক্লাস, একবার দেখা করে যাই l তা হঠাৎ এমন জোর বৃষ্টি এল, বাস পেলাম না, হেঁটে হেঁটে এতটা আসতে হল l হলুদ পাঞ্জাবী ভিজে গায়ে লেপ্টে রয়েছে l রোগা তালপাতার সেপাইয়ের মত চেহারায় একমুখ দাড়িগোঁফ, চোখে ভারি ফ্রেমের চশমা l ঋতুদির গোলগাল সন্ধ্যা রায়ের মত মিষ্টি চেহারার পাশে এক্কেবারে বেমানান l তবু এই প্রথম একজন জলজ্যান্ত কবি তার সামনে ! ওরা গল্প করছিল আর শর্মিলা সম্ভ্রমের চোখে স্বপ্নদীপদাকে দেখছিল l প্রায় আধঘণ্টা দাঁড়ানোর পর স্বপ্নদীপদা বলল
--স্ট্যান্ডে এখনও একটা ট্যাক্সি রয়েছে, ওটাই ধরি বরং l আজ আর বাস চলবে বলে মনে হচ্ছে না l শর্মিলা তুমিও চল আমাদের সঙ্গে, তোমার স্টপেজে নেমে যেও l
ট্যাক্সিতে উঠে ঋতুদির পাশে গা ঘেঁষে বসল স্বপ্নদীপদা l তুমুল বৃষ্টিতে চারদিক সাদা l ঋতুদির অন্যপাশে বসে শর্মিলা বুঝতে পারছিল ওরা ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হচ্ছে l ঋতুদির ভেজা শরীরের ওপর উঠে আসছে স্বপ্নদীপদার হাত l জানলার ঝাপসা কাচের দিকে প্রাণপণে তাকিয়ে শর্মিলা ক্রমশ সিঁটিয়ে যেতে লাগল l শর্মিলার উপস্থিতি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ওরা নিজেদের মধ্যে মগ্ন হয়ে থাকল l রীতিমত কান্না পাচ্ছিল শর্মিলার l বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি, ট্যাক্সি থেকে নেমে যাওয়ারও উপায় নেই l মুহূর্তগুলো এত প্রলম্বিত কেন ! প্রবল অস্বস্তি নিয়ে
নিজের স্টপেজের অপেক্ষায় বসে রইল শর্মিলা l ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ি থামাতে সম্বিৎ ফিরে পেল ওরা l ঋতুদি ঠেলে সরিয়ে দিল স্বপ্নদীপদাকে l একটাও কথা না বলে ট্যাক্সির দরজা খুলে নেমে গেল শর্মিলা l ওরা ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে গেল l
বাসস্ট্যান্ডে নেমে দেখল ছাতা হাতে উদ্বিগ্ন মুখে মা দাঁড়িয়ে রয়েছে l তাঁতের শাড়ির নীচের দিকটা বৃষ্টিতে ভিজে সপসপ করছে l বাড়ির গলিতে একহাঁটু জল l মেজাজ হারিয়ে চিৎকার করে উঠল শর্মিলা
--তুমি এখানে এসেছ কেন? এতটা পথ আসতে পারলাম আর এইটুকু রাস্তা যেতে পারব না !
--কি হয়েছে তোর মুন্নি? সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি, একটাও বাস আসছে না l আমার বুঝি চিন্তা হয় না ! তোর সঙ্গে ট্যাক্সিতে কে ছিল... ঋতু? ওর বাড়ির কেউ কি গিয়েছিল ওকে আনতে?
--আজ রোববার l বাড়িতে তো সবাই ছিল l বাবা, ছোটকা কেউ আসতে পারল না ! তোমাকেই আসতে হল ! আশ্চর্য !
চুপ করে গেলেন অপর্ণা l মায়ের উদ্বেগ, দুশ্চিন্তার কথা এখন এ মেয়েকে বোঝানো যাবে না l অরুণের শরীর ভালো নয়, সর্দিকাশি - জ্বর l আর অলোক- শবনম আজকাল বাড়ির অন্যান্য সমস্যা একটু যেন এড়িয়েই চলে l সারা সপ্তাহ দুজনেই অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকে l রবিবার ছুটির দিনে বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে একটু নিজেদের মত মুনমুনকে নিয়ে সময় কাটায় l কোনোদিনই নিজের সমস্যা বা দুশ্চিন্তার কথা কাউকে মন খুলে বলতে পারেননি অপর্ণা l এখন তো আরো ইতস্তত বোধ হয় l
মায়ের প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়েও গুম হয়ে গেল শর্মিলা l মাকে কিছুতেই ওর দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারল না l
বিকেলের দিকে বৃষ্টি একটু ধরলেও বাড়ির সামনের জমা জল নামল না l আজ মৈত্রেয়ীর সঙ্গে দেখা হওয়াটা খুবই দরকার ছিল l শম্পা এসেছিল বিকেলে, ওকেও কিছু বলতে পারল না শর্মিলা l বরং শম্পা খবর দিল সকালে মিষ্টি কিনতে গিয়ে ওর মেঘনার সঙ্গে দেখা হয়েছে l মেঘনার বিয়েটা এখন ওর বাবা - মা মেনে নিয়েছেন l ও এখন কয়েকদিনের জন্য বাপের বাড়িতে এসেছে l লাল শাড়ি, গয়না, একমাথা সিঁদুর পরে মেঘনাকে অপূর্ব লাগছিল l শম্পা বলল
--- চল এরমধ্যে একদিন মেঘনাদের বাড়িতে যাবি? মঙ্গলবার তো টিউশন নেই তোর l আমিও ফ্রী l চল ওর সঙ্গে দেখা করে আসি l
--হ্যাঁ, গেলে সৌমিলির সঙ্গেও দেখা হবে l অনেকদিন দেখা হয়নি ওর সঙ্গে l
--হ্যাঁ... তোর তো প্রাণের বন্ধু ! দেখা হলেই শুধু নিজের গুণকীর্তন করবে ! আমরা তো কেউ ওর পায়ের নখের যোগ্য নই কি না ! কি করে যে ওকে সহ্য করিস তুই !
খুব হাসল ওরা দুজন l মনটা একটু হলেও হালকা হল l
সোমবার স্কুলে মৈত্রেয়ীকে ঘটনাটা বলল শর্মিলা l মৈত্রেয়ী শুনে বলল
--বিষয়টাকে এতটা ইম্পর্টেন্স দিস না শর্মিলা l ঋতুদির কাছে এটা একটা খেলা l ও নিজেও কিন্তু ওই পরিবেশ আর স্বপ্নদীপদাকে ইউজ করেছে l
--কি বলছিস তুই ! ওরা সিরিয়াসলি কমিটেড ! কিন্তু আমার যেটা খারাপ লেগেছে সেটা হল ওদের প্রাইভেট মোমেন্টস ওরা পাবলিক করে ফেলল ! আমাকে একেবারে ইগনোর করল কেন !
-- তুই কি জানিস ঋতুদির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে !
--ক কই না তো ! তুই কি করে জানলি? স্বপ্নদীপদা তো কিছুই করে না তেমন l আজই তো ঋতুদি বলছিল...
--আরে এটা অন্য ছেলে l ঋতুদির বাবা আমার বাবার আন্ডারে কাজ করেন l এই তো দুদিন আগে বাড়িতে বিয়ের কার্ড দিয়ে নেমন্তন্ন করে গেলেন l মেয়ের নাম আর ডেসক্রিপশন শুনেই বুঝতে পেরেছি এটাই তোর ঋতুদি l তখনই অবাক লেগেছিল l তোর কাছেই তো শুনেছি স্বপ্নদীপদার কথা ! ওর যার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে সে ইঞ্জিনিয়ার, ইউ এসে থাকে l বিয়ের পরেই ঋতুদি বিদেশে চলে যাবে l
শর্মিলা বুঝতে পারল ঋতুদি ধ্রুবকে নিয়ে সেদিন যা বলেছিল, সেটা নিছক ইয়ার্কি নয় l ও ওরকমভাবেই ভাবে l স্বপ্নদীপদা ঋতুদির কাছে নিছকই সময়কাটানোর উপাদান l হয়ত স্বপ্নদীপদারও তাই ! ঋতুদির বিয়ে হয়ে বিদেশে চলে গেলে ও হয়ত অন্য কোনো ঋতুদিকে খুঁজে নেবে l ওদের সম্পর্কটা আসলে অগভীর জলের ভাসমান শ্যাওলার মত l
মঙ্গলবার স্কুল থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে শম্পা আর শর্মিলা মেঘনাদের বাড়ি গেল l ওদের হৈহৈ করে জড়িয়ে ধরল মেঘনা l একটা নীল রঙের চুড়িদার পড়েছে মেঘনা l হাতভর্তি শাঁখা - পলা, চুড়ি l সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর l অনেকদিন পরে দেখা হল, একদম অন্যরকম লাগছিল মেঘনাকে l শম্পা তো বলেই ফেলল
--তোকে একদম শ্রীদেবীর মত সুন্দর দেখতে লাগছে রে মেঘনা l
মেঘনার বর আউটডোর শুটিং এ গেছে, তাই মেঘনা এখন কিছুদিন বাবা - মায়ের কাছে থাকবে l
ওর বর মেঘনার কাজের জন্যও খুব চেষ্টা করছে l এর মধ্যে দু - তিনটে প্রোডাকশন হাউজে অডিশনও দিয়েছে ও l শর্মিলা বলল
--সব ঠিক আছে l কিন্তু তুই অন্তত মাধ্যমিক পরীক্ষাটা দেওয়ার চেষ্টা কর l অভিনয় করতে গেলেও তো মিনিমাম পড়াশোনার দরকার হয় l পড়াশোনাটা ছাড়িস না l
--তুইও দেখছি আজকাল সৌমিলির মত কথা বলছিস ! আমার পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না, করব না ব্যস ! থাম দেখি ! এসব ঘ্যানঘ্যানানি আমার মোট্টে ভালো লাগে না l
(চলবে )
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন