#৬
শেষ পর্যন্ত সামুয়েলের ফেরার টিকিট কনফার্ম হয়ে গেল। আজ থেকে চার দিনের মাথায় তার ফ্লাইট। বাড়ির জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে ওর খুব। কেমন আছে পরিবার, পরিজনেরা? তার দেশ? করোনার প্রকোপ বেড়েছে প্রচণ্ড হারে। কী এক নতুন রোগ এলো, আর তাবড় বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসের তাণ্ডব আটকাতে ব্যর্থ হয়ে গেল। অতিমারির সংজ্ঞা কাকে বলে তার আভাস পাচ্ছে সে এখানে বসে। যদিও সামুয়েল জানে না, সেই প্রকোপের তীব্রতা সতিই কতটা। অনুমানে আর সংবাদ মাধ্যমের ভাসা ভাসা খবরে প্রকৃত ঘটনা কিছুতেই বোঝা যায় না। দেশের জন্য মন টানছে ওর। হোম সিক হয়ে পড়ছে। অভিজিতের সঙ্গে কথা হচ্ছিল ওর এই নিয়ে। মন ভালো রাখার জন্য অভিজিৎ আগামীকাল একটা পিকনিকের আয়োজন করেছে। সবাই মিলে রান্না, খাওয়া হবে। হৈচৈ করে কেটে যাবে সারাদিন।
সেই মতো প্রবল উৎসাহ আর সাইকেল ও গিটার নিয়ে সামুয়েল, অভিজিৎ, বুলবুল আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা সক্কাল সক্কাল হাজির হল সেই বিশাল গাছের নিচে। এই এলাকা তাদের প্রাণ। এখানে জমায়েত না হলে ওদের আনন্দ যেন পুরোমাত্রায় হয় না। ওখানে এসে ওরা দেখে গ্রামের আরও সবাই হাঁড়িকুঁড়ি, উনোন, বালতি গামলা নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে গেছে। সবজি কাটছে মহিলারা। পুকুরের জ্যান্ত মাছ ধরে নিয়ে এসেছে জাল ফেলে কে যেন। কারা আবার মুরগি ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এদিকে এক কড়া ফুটন্ত তেলে চপ ভাজা হচ্ছে। ধামায় করে মুড়ি নিয়ে বসে পড়েছে আপাতত সকলে জলখাবারের আশায়। তেলেভাজার গন্ধে বাতাস উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে। সামুয়েলকে দেখেই সকলে হইহই করে উঠল। বাচ্চাগুলো ওর হাত ধরে, জামা ধরে টানাটানি শুরু করল। গান হোক, গান হোক—সমস্বরে দাবী জানালো সবাই। সামুয়েলও হাসিমুখে নাকে গন্ধ টেনে গিটার ধরল-
Me gusta la canela, me gustas tú.
Me gusta el fuego, me gustas tú.
Me gusta menear, me gustas tú.
Me gusta la Coruña, me gustas tú.
Me gusta Malasaña, me gustas tú.
Me gusta la castaña, me gustas tú.
Me gusta Guatemala, me gustas tú.
গানের এমন ঝঙ্কার যে সকলেই মাতোয়ারা তখন। মানে বোঝাও, মানে বোঝাও বলে অস্থির করে তুলল বাচ্চাগুলো। সামুয়েল যথাসাধ্য চেষ্টা করল-
আমার দারচিনি ভালো লাগে, আমার তোমাকে ভালো লাগে।
আমি আগুন ভালোবাসি, তোমাকেও ভালোবাসি।
আমি নাচতে ভালোবাসি, তোমাকে ভালোবাসি।
আমার মালাসানা ভালো লাগে, তোমাকেও ভালো লাগে।
আমার কাঠবাদাম ভালো লাগে, তোমাকে ভালো লাগে।
আমি গুয়েতামালাকে ভালো বাসি, তোমাকেও ভালোবাসি।
সবাই রান্নাবান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল এরপর। সামুয়েলের সাইকেল নিয়ে কসরত শুরু করল কয়েকটি বাচ্চা। কেউ খেলছে, কেউ নিছকই আড্ডা দিচ্ছে, বুলবুল তার বন্ধুদের সঙ্গে কিতকিত খেলছে। ওকে এখন আর কিশোরী মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে নেহাতই এক বালিকা। মায়ায় মন আচ্ছন্ন হয়ে গেল সামুয়েলের। আর কদিন মাত্র থাকবে সে এখানে। কী নিষ্পাপ, পবিত্র মানুষগুলো! এদের মনে থাকবে ওর। এইসব ভাবতে ভাবতে সামুয়েল স্বভাববশত একটু দূরের গাছতলায় গিয়ে বসে ছিল চুপচাপ। হাঁ করে আকাশের মেঘের খেলা দেখছিল। মাংস রান্নার গন্ধ বাতাসে ভাসছে। গ্রামের যত কুকুর, বেড়াল, তারাও অংশ নিয়েছে আজ পিকিনিকে। একটা কুকুর ওর দিকে তাকিয়ে ভুক ভুক করে ডেকে উঠল আচমকা। হয়ত সামুয়েলকে চিনতে পারেনি। ওর ডাক শুনে বুলবুল এগিয়ে এলো। ভুলুকে তাড়িয়ে দিয়ে সামুয়েলকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি এখানে চুপচাপ বসে আছ কেন? সবাই ওদিকে রয়েছে…তোমার ভালো লাগছে না এখানে?’ ওর কথায় সচকিত হয়ে উঠে দাঁড়াল সামুয়েল। বলল, ‘না না ভালো লাগবে না কেন? খুব ভালো লাগছে। ভাবছি, আর তো কদিন, দেশে ফিরে যাব। তোমাদের গ্রামের ওপর খুব মায়া পড়ে গেছে’। এই বলেই সে গিটারে সুর তুলল-
Voy a reír, voy a bailar
Vivir mi vida lalalalá
Voy a reír, voy a gozar
Vivir mi vida lalalalá
(আমি হাসতে চাই, আমি নাচতে চাই
জীবন উপভোগ করছি লালালালা
আমি হাসতে চাই, আমি আনন্দে থাকতে চাই
জীবন উপভোগ করছি লালালালা।)
বুলবুল এই গানের মানে জানতে চাইল না, গানের সুর আর সামুয়েলের চকচকে চোখের আনন্দ দেখে বুঝে গেল গানের নিহিত অর্থ। নির্দ্বিধায় সামুয়েলের হাত ধরে হাসতে হাসতে ওকে নিয়ে চলল জটলার দিকে।
(ক্রমশঃ)
ভালো লাগল
উত্তরমুছুনভালো লাগল
উত্তরমুছুনভালো লাগল
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ। তিনবার মন্তব্য এসে গেছে আপনার।
মুছুন