প্রেম ঝরে অনিবার
চৈতালী ভৌমিক
স্কোরপিয়ো গাড়ির একিধারের দুটি দরজাই খোলা। গাড়ির মধ্যে বসে আছেন পুলিশের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। গাড়ির মধ্যে বেজে চলেছে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার গাওয়া ' এমনো দিনে তারে বলা যায় '। সুরার গ্লাস হাতেই ধরা, অপর হাতে নিঃশেষ হচ্ছে সিগারেট। তন্ময় হয়ে বৃষ্টি দেখছে কুনাল সান্যাল। বিশ্বচরাচর জুড়ে শুধু বৃষ্টির শব্দ। বিদ্যুৎ ঝিলিকেই একমাত্র বোঝা যাচ্ছে কুনালের চোখের নোনা পানির ধারা ভিজিয়ে দিচ্ছে বুক।
দোর্দণ্ড প্রতাপ কুনাল স্যারের চোখেও জল আছে ! ভেবে অবাক হয় নতুন ড্রাইভার বিরাজ। একবার ভাবলো স্যারকে ডাকবে কিনা,তারপরেই কি ভেবে চুপ করে গেলো। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে চাঁদুর চরে, সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে দ্বারকেশ্বর। ওপাশের চড়ের সবুজ বনানী উথাল-পাতাল হয়ে যেনো মিলিত হতে চায় দ্বারকেশ্বরের সাথে। নদীর আকাশে কালো মেঘের ঘূর্ণি হুহু করে বয়ে যাচ্ছে এধার থেকে ওধার, যেনো কোনো বন্য পাগল হাতি উদ্দামতার সাথে ছুটে চলেছে সংগীনীর দিকে। বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা জল নদীর বুকে সহস্র বৃত্ত রচনা করে চলেছে।তার দিকে একমনে তাকিয়ে কুনাল ভাবে, তার জীবনের বৃত্ত কি পূর্ণতা পাবে কখনো? নাকি এভাবেই শুধু ছন্নছাড়া হয়ে নিঃশব্দে বয়েই যাবে ভালোবাসার ফল্গুধারায়।
হঠাৎ গান থেমে যেতেই, বিরাজ চালিয়ে দেয় তার প্রিয় কিশোরের গান ' রিমঝিম গিরে শাওন '। ছন্দ পতন হতেই চমকে ওঠে কুনাল। বিরক্তি হতে গিয়েও হাতের গ্লাস টা শেষ করে, আরো দু পেগ খেয়ে নেয়। তারপর বিরাজ কে বলে আবার সেই রবীন্দ্র সংগীতটাই চালিয়ে দিয়ে, গাড়ি এগিয়ে সামনের এক সরকারী বাগান বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিতে। বাগান বাড়ির কেয়ার টেকার কুনালের চেনা। তাই কুনালের পছন্দের একটি ঘর খুলে দেয় সে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে কুনাল এগিয়ে যায় সামনের পুকুরটার দিকে।পা টা কি অল্প টাল খেলো! ভেবেই কুনাল পুকুরের দুপাশে বসার জায়গায় বাঁধানো ঘাটের একটি তে বসে ঝুপুস হয়ে ভিজতে থাকে। কানের মধ্যে, বুকের মধ্যে বাজতে থাকে একটিই গান ”এমনো দিনে তারে বলা যায়
সে কথা শুনিবে না কেহ আর,
নিভৃত নির্জন চারি ধার।
দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি,
আকাশে জল ঝরে অনিবার –
জগতে কেহ যেন নাহি আর॥"
কোথায় পিহু, আর কোথায় সে। কিছুতেই পিহুকে ভুলতে পারেনা কুনাল। আজকের এই দোর্দণ্ড পুলিশ কেন যে তখন বলতে পারেনি পিহুকে তার মনের সকল কথা সাহস করে! আজ তাহলে হয়তো তার পাশে, তার সাথে থাকতো পিহু।
তখন সদ্য কলেজ পাশ করে, বেকার কুনাল কিছু টিউশনি জুটিয়ে নিয়েছিলো হাত খরচের জন্য। সাথে চলছিলো পুলিশে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য পড়াশোনা ও শরীর চর্চা। প্রথম দেখাতেই পিহুকে পছন্দ হয়ে যায়। কিন্তু শিক্ষক হয়ে সদ্য ঢুকেছে, এখনি প্রেম নিবেদন ঠিক নয় ভেবে, নিবেদিত প্রান হয়ে পিহুকে পড়াতো কুনাল। সময়ের অপেক্ষা করছিলো শুধু। ভেবেছিলো পিহুর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরেই তার মনের কথা জানিয়ে দেবে। কিন্তু এদিকে ভিতর ভিতর পিহুও যে কুনালের প্রতি আকৃষ্ট বুঝেও বোঝেনি পিহুর স্বার্থে। এদিকে পিহুর পরীক্ষা চলা কালীন কুনাল পাশ করে পুলিশের পরীক্ষায়। পিহুর সাথে ঠিক মতো দেখা করার ও সুযোগ পায় না, চলে যেতে হয় ট্রেনিং এ। ট্রেনিং শেষে বাড়ি ফিরে শোনে পিহুর বিয়ের সব ঠিক। সেই সময় হঠাৎ একদিন পিহু চলে আসে কুনালের কাছে। বলে তার আকাংখিত মনের সেই কথাটি। কিন্তু সদ্য চাকরি পাওয়া কুনাল সাহস পায় না দুঃসাহসিক কিছু করে ওঠার। ফিরে যায় পিহু।
কিছুদিন আগে কোচবিহারে একটি কাজে গিয়ে হঠাৎ দেখা পিহুর সাথে। কোনো এন জিওর সাথে যুক্ত সে। বিয়ে ভেংগে গেছে বিয়ের পরপরেই। ফিরিয়ে আনতে চায় এখন সে পিহুকে নিজের জীবনে। কিন্তু পিহু কঠিন বর্মে ঢেকে নিয়েছে নিজেকে।
কথা হয় ফোনে, তবে সে শুধুই কথা। মনের কথা বলার সাহস আজও পায়না। ভয় পায় কুনাল, যদি পিহু ফিরে আসতে না চায়।
বাগান বাড়ির রুমে ফিরে যায় বৃষ্টি স্নাতো কুনাল। ফ্রেশ শাওয়ার নিয়ে টাওয়াল জড়িয়ে আবার বসে বোতল আর গ্লাস নিয়ে। সামনের জানালা দিয়ে হালকা ছাঁট আসছে বৃষ্টির। পুকুরের চারপাশে তালগাছের সারি। তার ছাওয়া পরে পুকুরের চারপাশ অপূর্ব এক ছবি এঁকেছে যেনো। আজ যেন প্রকৃতি চাইছে কুনাল দুঃসাহসিক কিছু করুক। হাতে ফোন টা তুলে ডায়ল করলো 9433544142.
- হ্যালো, স্যার
- পিহু
- হ্যাঁ আমি বলছি
কুনাল কানে ফোন চেপে ধরে আছে, শুনতে পাচ্ছে ওধারে গান চলছে ' এমনো দিনে তারে বলা যায় '
- পিহু, আজ আর স্যার নয়। আজ কুনাল সান্যাল ফোন করেছে তোমায়।
খানিক চুপ থেকে, পিহু শুনছে কুনালের ঘরেও গান চলছে ' এমনো দিনে তারে বলা যায় '...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন