সোমবার, ২১ জুন, ২০২১

কাজল সেন

                                  



অমীমাংসিত খেলা

“আসলে বুঝলি, অনিরুদ্ধ ড্রিবলিংটা এত ভালো করে যে, ওকে আটকে রাখা খুব মুশকিল। আর ঐ

ড্রিবলিং করতে করতেই অনায়াসে পৌঁছে যায় একেবারে বিপক্ষের গোলপোস্টের মুখে”।

হঠাৎ তেড়িয়া হয়ে সান্টু বলল, “তুই থাম তো মনা! অনিরুদ্ধ ভালো ড্রিবলিং করে! আরে ব্রাদার,

শুধু ড্রিবলিং করলেই কি ভালো ফুটবলার হয় নাকি! ঘেঁচু হয়। ড্রিবলিং-এর সাথে সাথে ট্যাকেলিং

আর শ্যুটিংটাও জবরদস্ত হওয়া দরকার, বুঝলি?”

ত্রিদিব পাশে বসে একমনে সিগারেট টানছিল। কথাটা শুনে ফোড়ন কাটল, “আবে গুরু, আজকের দিনে

শুধু ঐটুকুতে চলে না, বুঝেছিস? ফুটবল এখন অনেক আধুনিক হয়ে গেছে। পাসিং হচ্ছে সব থেকে

জরুরি ব্যাপার। ওয়ান টাচ গেম। ঠিকঠাক পাশ করতে না পারলেই বল চলে যাবে অপোনেন্ট

প্লেয়ারের পায়ে। আর তখন উজবুকের মতো দাঁড়িয়ে বুড়ো আঙুল চোষ্‌!”

সুপ্তি এতক্ষণ বোর হচ্ছিল। ফুটবল নিয়ে এইসব বুকুনি তার ভালো লাগছিল না। ফুটবলটা সে ঠিক

বোঝেও না। বরং টিভির কল্যাণে যেটুকু খেলা দেখে, তা ঐ ক্রিকেট। ক্রিকেটও অবশ্য সে তেমন

কিছু বোঝে না, তবু ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা হলে কিছুটা স্বস্তি বোধ করে। আর তাই আলোচনাটা

ফুটবল থেকে ক্রিকেটে ঘোরাতেই অনেকটা বিশেষজ্ঞের মতো বলে, “তোরা যাই বল না কেন,

আসল খেলা হচ্ছে ক্রিকেট। ওসব ফুটবল-টুটবল ক্রিকেটের ধারে কাছে ঘেঁষতেই পারে না!”

শরদিন্দু চুপ করে সবার কথা শুনছিল। এবার সুযোগ পেয়ে সে নেমে পড়ল মাঠে, “তুই ক্রিকেটের কী

বুঝিস রে সুপ্তি? কিচ্ছু বুঝিস না! আর এই যে সব পন্ডিতরা ফুটবল নিয়ে বড় বড় বাতেলা ঝাড়ছে,

এরাও ফুটবলের ঘন্টা বোঝে! কোনোদিন বারপোস্টের ভেতর ঠিকঠাক একটা শট্‌ মারতে পারল না,

আর গান্ডুরা এয়েছেন আধুনিক ফুটবল নিয়ে সেমিনার করতে!”

সুপ্তি কথাটা মেনে নিল – “তা তুই কথাটা একরকম ঠিকই বলেছিস শরদিন্দু, আমিও কোনোদিন

ক্রিকেটব্যাট ধরিনি। তবু কী জানিস্‌, ক্রিকেট দেখতে আমার ভালো লাগে, খুব ভালো লাগে!”

আজ বেমওকা ফুটবল নিয়ে কেন এরা মেতে উঠল, তা আঁচ করতে পারছিল না হেমলতা। তার

আশঙ্কা হলো, ফুটবলের পা ছেড়ে এবার হয়তো হাতে উঠে আসবে ক্রিকেটব্যাট। অসহ্য! অসহ্য!

এসব পোষায় না তার একেবারেই। শরদিন্দুর টি-শার্টের হাফহাতা ধরে সে টপকে পড়ল মাঝমাঠে –

“মাইরি, যা বলেছিস তুই শরদিন্দু! এরা কেউ কিছুই বোঝে না। নিরেট গবেট। শুধু অন্যের মুখের ঝাল

খেয়ে বেড়ায়। আসলে খেলাটা তো অন্য কেউ খেলছে!” হেমলতা এবার সুপ্তিকে নিয়ে পড়ল, “আর

তোর ক্রিকেট কেন ভালো লাগে রে সুপ্তি?” হকচকিয়ে সাদামাটা গলায় সুপ্তি বলল, “কেন ভালো

লাগে মানে? ভালো লাগে, তাই ভালো লাগে”।


হেমলতা এবার নিজের মনের মতো বিষয় পেয়ে হামলে পড়ল সুপ্তির ওপর – “দেখ্‌ সুপ্তি, তুই যেটা

তোর নিজের ভালো লাগা বলে মনে করছিস, সেটা আসলে কিন্তু তোর নিজের ভালো লাগা নয়। তোকে

অন্য কেউ সেটা ভালো লাগতে বাধ্য করছে। মানে তোর ভালো লাগাটা তোর হাতে নেই, অন্য কারও

হাতে আছে। এই যেমন দেখ্‌ না, তুই কোন্‌ পেস্টে দাঁত মাজবি, সেটা ঠিক করে দেবে অন্য কেউ।

তুই মাথায় কোন্‌ তেল মাখবি এবং কোন্‌ শ্যাম্পু দিয়ে আবার সেই তেল তুলবি, সেটাও তোর ভালো

লাগায় কিছু এসে যায় না, অন্যের ভালো লাগার ওপর নির্ভর করে। এবং এভাবেই কোন্‌ সাবান,

কোন্‌ মিনারেল ওয়াটার, কোন্‌ টিভি, কোন্‌ ফ্রিজ, কোন্‌ হেয়ার রিমুভার, কোন্‌ স্যানিটার

ন্যাপকিন্‌, এমন কী কোন্‌ কন্ডোম তোর ভালো লাগা উচিৎ, সেসব অন্যরাই ঠিক করে দেবে,

যারা আসল খেলাটা খেলছে। কিছু বুঝলি? তোর ক্রিকেট খেলা ভালো লাগার পেছনেও ঠিক এই

খেলাটাই খেলছে ওরা। এটাকে তুই বলতে পারিস বাজার-বাজার খেলা। এমন কী দেখ্‌ না, কোন্‌ বছর

কোন্‌ দেশের মেয়ে বিশ্বের সুন্দরী শ্রেষ্ঠা হবে, যাকে সবার ভালো লাগবে, তাও ওরাই বেছে দেবে।

বুঝলি কিছু?”

সুপ্তির মনে হলো হেমলতা কথাটা হয়তো ঠিকই বলছে। তবু একটা কিছু না বললে তার মুখরক্ষা হয়

না। তাই বলল, “তুই কিন্তু খুব জ্ঞান দিচ্ছিস্‌ আমাকে! এবার থাম্‌। আমার পেট ভরে গেছে”।

হেমলতা হেসে বলল, “বুঝেছি বুঝেছি, এসব শুনতে তোর ভালো লাগবে কেন! জমিয়ে প্রেম করছিস,

ছোঁয়াছুয়ি করছিস্‌, প্রেমের ন্যাকা ন্যাকা ফ্যাচফ্যাচানি শুনছিস, এসব কেন ভালো লাগবে এখন!

আর জুটিয়েছিস্‌ও এমন একজনকে, কী আর বলব তোকে! আজ তো দেখছি সে আবার ফুটবলের

ড্রিবলিং নিয়েও লেকচার ঝাড়ছে!” ফাঁক পেতেই শরদিন্দু এবার বিশেষজ্ঞের মতামত পেশ করল,

“আমিও তো তাই ভাবছি রে হেমলতা! মনা ফুটবলের ভক্ত আর সুপ্তি ক্রিকেটের। তা হ্যাঁ রে,

তোদের প্রেম হলো কেমন করে?”


প্রেমের কথায় খুব বিষণ্ন হলো ত্রিদিব। শরদিন্দু যাই বলুক না কেন, ফুটবল সে খেলেছে, ভালোই

খেলেছে, ফুটবলের নিয়ম কানুন সে জানে। এবং আধুনিক ফুটবলেরও খোঁজখবর রাখে। টোটাল

ফুটবলের ধারণাটা তার মাথায় ঢুকিয়েছিল তার পাড়ার ক্লাবের কোচ পল্টুদা। পল্টুদা বলত, বল

কখনও বেশিক্ষণ নিজের পায়ে ধরে রাখবি না। সহ খেলোয়াড়কে পাস করবি। এবং এভাবেই পাসিং

গেম খেলতে খেলতে গোটা দলটাই উঠে যাবি বিপক্ষ দলের গোলের মুখে। আবার যখন বিপক্ষ দলের

পায়ে বল চলে যাবে, তখন গোটা দলটাই নেমে আসবি রক্ষণ সীমানায়। মনে রাখবি, ফুটবল কারও

একার খেলা নয়, এটা দলগত খেলা, টিম গেম।

ত্রিদিব আরও জানে, মাঠের খেলাটা মাঠেই রেখে আসতে হয়। মাঠের বাইরে তা কখনই নিয়ে আসা

ঠিক নয়। আবার মাঠের বাইরের কোনো খেলাও কখনই মাঠে নিয়ে যেতে নেই। কিন্তু মধুপর্ণা কেন

এমন করল? সে কেন তাদের ব্যক্তিগত নিভৃতের খেলাকে টেনে নিয়ে গেল মাঝমাঠে? ত্রিদিব তো

মধুপর্ণাকে একান্তই নিজের করে পেয়েছিল। নিজের কাছে ধরে রাখতে চেয়েছিল। এটা তো ফুটবল

নয়! সে তো কোনো পাসিং গেম খেলতে চায়নি মধুপর্ণাকে নিয়ে! তাহলে? তাহলে মধুপর্ণা কেন তাকে

ছেড়ে চলে গেল অনিরুদ্ধর কাছে?

1 টি মন্তব্য:

  1. এই যে শেষ অনুচ্ছেদে তীব্র মোচড়, সেটা অমীমাংসিত করে রাখলো বৈকালিক খেলার আস। এখানেই চ্যাম্পিয়ন কাজল সেন
    অভিনন্দন।

    উত্তরমুছুন