বেজন্মা ( চতুর্থ ভাগের পর)
“আমাকে এবার উঠতে হবে পিসিমা। অনেক বেলা হলো। ইচ্ছে আছে আগামীকাল অথবা পরশু শান্তিনিকেতন দেখে কলকাতায় ফিরবো। শামসুদ্দিনকে বলব আপনাদের কথা। আপনার ভাই, মানে আকবর চাচা পাশপোর্ট করে আসবেন শুনছিলাম…”।
“সেকি! এতদূর থেকে এসেছো। এই দুপুরে খেয়ে না গেলে গৃহস্তের অকল্যাণ হয় বাবা। একটু বসো বাবা। রাবেয়ারও আসার সময় হলো”। কৃষাণকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ভদ্রমহিলা ভেতরে চলে যান। কাকে যেন ডাকাডাকি করতে শোনে কৃষাণ। ওনার কথায় এমন কিছু ছিলো যে, না বলতে পারে না। উঠে গিয়ে টেবিলের ওপর রাখা বইগুলি নাড়াচাড়া করতে থাকে।
“কাউকে না জিজ্ঞাসা করে বইগুলো দেখছেন যে…” মহিলার কন্ঠস্বরে চমকে তাকায় কৃষাণ। সাদা সালোয়ার কামিজ আর লাল দোপাট্টা গলায় জড়িয়ে দরজায় সতেরো আঠেরো বছরের মেয়ে। দিঘীর মতো গভীর চোখ, দীঘল কালো চুল শক্ত করে বেনুনী করা, চেহারায় অযত্নের ছাপ। কৃষাণ বুঝতে পারে এই মেয়েটিই রাবেয়া।
“না, মানে আমি একটু দেখছিলাম…”।
“না বলে কারো জিনিস দেখা ভদ্রতার মধ্যে পরে না, এটা জানেন না?” ‘আম্মু…’ ডাকতে ডাকতে ভেতরে চলে যায় মেয়েটি। ভেতর থেকে মেয়েটির গজরানো শুনতে পায় কৃষাণ… ‘আবার তুমি নিয়ে এসেছো…? আমি তো বলেছি, বিয়ে আমি করবো না’। মনে মনে হাসে কৃষাণ। বেশ কিছুক্ষণ পর রাবেয়াকে নিয়ে ফিরে আসে ভদ্রমহিলা।
“কিছু মনে করোনা বাবা, এই আমার মেয়ে, ‘রাবেয়া’। বাড়িতে কেউ এলেই মেয়ে এরকম করে। তোমাকে তো আগেই বলেছি…”। মেয়েটি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। কৃষাণ হাত জোড় করে…।
“আমি কৃষাণ, আপনার আকবর চাচার ছেলে, শামসুদ্দিনের বন্ধু। আপনাদের খবর নিতে এসেছি”।
“ওকে ‘আপনি’ বলছো কেন? কত ছোট তোমার থেকে…”।
“হ্যাঁ, আমাকে তুমিই বলবেন। কিছু মনে করবেন না, আমি ভেবেছিলাম…”। মাথা তুলে কৃষাণের দিকে তাকায় মেয়েটি।
“নে, তোরা কথা বল, আমি ওদিকের কাজ সারি” ভদ্রমহিলা ভেতরে চলে যান। মেয়েটি টেবিলের পাশে রাখা চেয়ারে বসে। একটা পেন নিয়ে মেয়েটি টেবিলের ওপর পাতা কাগজে আঁকিবুঁকি কাটে। কৃষাণই নিরাবতা ভাঙ্গে।
“আমি বিএসএফ-এ কাজ করি হিলি বর্ডারে। সেখানেই শামসুদ্দিনের সঙ্গে আলাপ। শামসুদ্দিন বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড-এ কাজ করে। তবুও আমাদের বন্ধুত্বে কোনও বাধা হয়নি। আসলে আমরা তো সবাই একই দেশেরই। রাজনৈতিক ফেরে বিছিন্ন হয়েছি। শামসুদ্দিনের অনুরোধে আজই এখানে এসেছি, কালকেই চলে যাব। তুমি তো সামনের বার হাইয়ার সেকেন্ডারি দেবে? তারপর কী করার ইচ্ছে”। কৃষাণের কথায় সহজ হয় রাবেয়া।
“গ্র্যাজুয়েট হয়ে চাকরীর চেষ্টা করতে হবে আমাকে। কিন্তু মা তো বোঝা নামানোর জন্য ব্যস্ত। সেই জন্যই তো আপনাকে দেখে…। তার কথা শুনে হাসে কৃষাণ।
“খুব ভালো। মেয়েদের আত্মনির্ভর হওয়াটা খুব দরকার। তারপর মাস্টার্সও করতে পারো”।
“সেটা বোধহয় হবে না কোনোদিন। অন্তত একটা চাকরী খুব দরকার। এভাবে বেশীদিন চলতে পারে না”।
“জানো, আমি চলেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু পিসিমা এমন করে বললেন…। শুধু শুধু কষ্ট করতে হচ্ছে আমার জন্য”।
“সেকি, এতদূর থেকে আমাদের জন্য এসেছেন, এইটুকু না করলে আমাদেরই খারাপ লাগতো…”।
“ঠিক বলেছিস, নাও বাবা, হাতপা ধুয়ে নাও, আমি খেতে দিচ্ছি। রাবেয়া, কৃষাণ’দাকে সাবান আর বালতিতে পানি ভরে দে”।
( ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন