সোমবার, ২১ জুন, ২০২১

সিলভিয়া ঘোষ

                                              



এক পশলা বৃষ্টি 




আচমকা  ছুটির  দিনের ভাত ঘুমটা  ভেঙে যেতেই জানালায়  চোখ চলে গেল  অন্বেষের।   মেঘ করে  এসেছে চারিদিকে, বিদ্যুৎ এর  পলকের সঙ্গে  বড় বড় ফোঁটা বৃষ্টি নামছে  এই  রূক্ষ  ঝাড়খণ্ডের  টিলার ঘেরা শহরতলী  চাতরা  অঞ্চলে।  বৃষ্টি  এখানে  কম হয় না  তবুও খুব  রূক্ষ  এই  জঙ্গলাকীর্ণ  মালভূমি।  অন্বেষ  এখানে আসা অবধি   তেমন  ঝড়  বৃষ্টি  দেখেনি  যা দেখেছিল  আয়লা,  বুলবুল , ফেণীর  সময়  কলকাতা কিম্বা  খড়্গপুরে।  বড় বড় বৃষ্টিফোঁটা গায়ে পড়তেই  ধড়মড়িয়ে  উঠে ঘরের বাকী দরজা জানালা বন্ধ  করে দিয়ে  ছোট্ট ব্যালকনিতে এসে  বসল টুল নিয়ে।    বাড়ির সামনেই সাপের মতোন ভিজচ্ছে বড় রাস্তাটা তার পিছনে বড় বড়  দেবদারু গাছ, ঝাউ গাছ  যেন  দীর্ঘ দাবদাহের পর  বৃষ্টি ফোঁটার আনন্দ  উপভোগ  করছে।  মাথা নেড়ে বর্ষাকে  যেন  স্বাগাত  জানাচ্ছে।  এমন মন খারাপ করা বিকেলে  অন্বেষের  ফেলে আসা  দিন গুলোর কথা  মনে পড়ে।  মনে পড়ে জেলের  ভিতর  পক্স হয়ে পড়ে থাকার  দিনগুলোর কথা,  এক ফোঁটা  জলের জন্য  আকুতি মিনতির  কথা,  বদলে জুটেছে তিরস্কার  আর অবহেলার  কথা।  অথচ  যার জন্য  এত  যাতনা সহ্য  করেছে সে তখন দিব্যি  ভিনদেশী তারা হয়ে  ধ্রুব তারার আশেপাশে  প্রতি দিন  জেলের  সেই এক টুকরো জানালার  ভিতর দিয়ে লুকোচুরি  খেলে অন্বেষের  সঙ্গে।  অন্বেষ আজও বুঝে উঠতে পারেনি  হঠাৎ  করে এমন শাস্তি কেন সে পেল?  সে তো কোন বড় রকমের অপরাধ  কোনদিন করেনি।  অপরাধ  তার একটাই হয়েছিল।৷   আজ তা বারবার নিজেকে প্রশ্ন  করে জানতে পেরেছে।  ভালোবাসা,  হ্যাঁ  এই ভালোবাসাই   ছিল তার সব রকম  কাঁটা। কিন্তু  কী করেনি সে এই ভালোবাসার জন্য।  জলের মতো টাকা,  বিদেশ  বিভুঁইতে সঙ্গে নিয়ে ভ্রমণ, রঙীন জলের  আসর ,  আই ফোন  সব...
 সওব  দিয়েছিল ভালোবাসাকে  বাঁচিয়ে  রাখতে। অথচ কী থেকে  কী যে হয়ে গেল!  ভাবতেই অবাক লাগে!  সে তো  জানত   অন্বেষ  তার  থেকে  দূরে  বেশিদিন  থাকতে পারেনা তবুও এই রকম সিদ্ধান্ত কেন যে  সে নিল  তা সহজে  বহুদিন পর্যন্ত  বোঝেনি অন্বেষা।  যত দিন গেছে ততই সে বারবার  নিজেকে প্রশ্ন করে করে বুঝতে পেরেছে 
যে  সমাজ ও পরিবারের প্রিয় সদস্যদের  বুঝিয়ে উঠতে অক্ষম হয়েছিল  তার ভালবাসা।  তাই  নিজেকেই  ডুবিয়ে রাখত   অলীক  জগতের আড়ালে। সে হয়তো বুঝতেই পেরেছিল নিয়তি তাদের মিলন হতে দেবে না সুস্থ  ভাবে।  সব কিছুর থেকে নিজেকে নির্বাসিত করে এক রঙীন সন্ধ্যায় মুখোমুখি  দু গেলাস রঙীন পাত্রকে সাক্ষী রেখে চারতলা থেকে ঝাপ দিয়ে সরিয়ে নিয়েছিল সে। বোবা  প্রেমিকের মতো সেদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে  দেখেছিল অন্বেষ সবটা।  সে যে একমাত্র  সাক্ষী ছিল এমন  আচমকা  দুর্ঘটনার!  কিন্তু  ঈশ্বর সাক্ষী, আকাশের চাঁদ ,  তারারা সাক্ষী ছিল  যে, অন্বেষ  নির্দোষ।   তবুও ... তবুও   জেলের শাস্তি সে  ভোগ করেছ  মুখ বুঝে।  এই বোধহয় ভালোবাসার  প্রতিদান।  যাকে ভালোবাসো তার জন্য  মুখ বুজে  শাস্তিও মাথা পেতে নেওয়া।  বাইরে তখন  হু হু করে  হাওয়া বইছে, এক পশলা মুষল ধারায়  বৃষ্টির পর চোখে  মুখে লেগে থাকা শীতল  বৃষ্টি ফোঁটা   আর  অশ্রুজল  কেমাফ্লেজ  হয়ে  গেছে অন্বেষের  মুখমণ্ডলে... ব্যালকনির  রেলিং  এ  দুহাত চেপে ধরে সে  মনে মনে বলে ওঠে আমাকে বাঁচতে দে  রাজা, আমাকে বাঁচতে দে!   আমাকে বাঁচতেই হবে  নিজের জন্য  নয়  এক জোড়া  বাবা মায়ের জন্য।  সেই  কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রাখা  রাজা  তখন মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে টুক করে ।  মধ্যবয়সী অন্বেষ  বর্ষাকে  গায়ে মাখে,  মুখে মাখে,  মাথা ভিজিয়ে শীতল হতে চায় বারে বারে! ভুলে থাকতে চায় বিগত অতীত কে!  কিন্তু  এই   এক পশলা বৃষ্টি তাকে  ভাসিয়ে দেয় এই ভাবেই ! 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন