সোমবার, ২১ জুন, ২০২১

শর্মিষ্ঠা দত্ত

                                 


অষ্টম পর্বের 

খোঁজ (৯)

ক্লাস টেনে মৈত্রেয়ী এসে ভর্তি হল শর্মিলাদের স্কুলে l ওরা আগে থাকত বহরমপুরে l ওর বাবা পুলিশের বড় অফিসার, চাকরিসূত্রে কলকাতায় বদলি হয়ে এসেছেন l সাধারণত ক্লাস টেনে নতুন স্টুডেন্ট নেওয়া হয় না l কিন্তু মৈত্রেয়ীর আগের স্কুলে দুর্দান্ত রেজাল্ট আর ওর বাবার চাকরির শর্ত অনুযায়ী ওর  ভর্তি হতে কোনো সমস্যা হল না l মৈত্রেয়ী প্রথমদিন থেকেই শর্মিলার পাশে বসতে শুরু করল l ছোট্টখাট্টো, টিংটিঙে রোগা, ঈষৎ উঁচু দাঁত আর চশমার মোটা কাচের আড়ালে ঝকঝকে দুটো চোখ সবসময় কৌতুক মাখানো l সকলের সঙ্গেই খুব তাড়াতাড়ি মিশে যেতে পারত মৈত্রেয়ী l শুধু শর্মিলা নয়, ক্লাসের সবাই খুব তাড়াতাড়ি ওর বন্ধু হয়ে গেল l থানার প্রেমিসেসে ওদের বিশাল কোয়ার্টার l শর্মিলাদের বাড়ির কাছেই l মৈত্রেয়ীর দিদি অনেকটা বড়, বিয়ে হয়ে গেছে, বম্বেতে থাকে l আর দাদা মেডিকেল কলেজে ফাইনাল ইয়ারে পড়ে l ওর মা কাবেরীকাকিমা শর্মিলাকে খুব ভালোবেসে ফেললেন l প্রায়ই  দারুণ দারুণ রান্না করে ওকে বাড়িতে ডাকতেন l এতদিনের এত বন্ধু থাকা সত্ত্বেও মৈত্রেয়ীর সঙ্গে অন্তরঙ্গতাটা অনেক গাঢ়  হল শর্মিলার l মৈত্রেয়ীর একটা স্বাভাবিক অন্তর্দৃষ্টি ছিল l মৈত্রেয়ী ওকে যতটা বুঝত, ও নিজেও বোধহয় নিজেকে তেমনভাবে বুঝতে পারত না l মৈত্রেয়ীরও অ্যাডিশনাল সাবজেক্ট ছিল অঙ্ক l শনি রবিবার মাঝে মাঝে রিজ্জুদার কাছে অঙ্ক করতে শর্মিলাদের বাড়িতে আসত মৈত্রেয়ী l যে কথাটা শর্মিলা নিজেও বুঝতে পারেনি বা নিজের কাছে স্বীকার করেনি, অল্প সময়েই মৈত্রেয়ী সেটা ঠিক বুঝে ফেলল l এতদিনে নিজের মনকে একটু একটু করে পড়তে পারল শর্মিলা l এরই মধ্যে সাগরিকা, সুদেষ্ণাদের প্রেম বন্ধুমহলে নিত্যদিনের চর্চিত বিষয় l ওদের বয়ফ্রেন্ডরা কিভাবে ওদের প্রপোজ করেছে, চিঠি লেখা, মান -অভিমান, মানভঞ্জনের সব গল্পই  বন্ধুদের গ্রূপে শেয়ার করে ওরা l রিজ্জুদা ওকে কোনোদিন প্রপোজ করেনি, লেখাপড়ার বাইরে অন্য কোনো আলোচনাও তেমনভাবে হয়নি ওদের মধ্যে কোনোদিন l একে কি প্রেম বলা চলে ! মনের মধ্যে সংশয়ের দোলাচল l রিজ্জুদা শর্মিলার থেকে অনেকটাই বড়, ওর শিক্ষক l তাই ওকে শ্রদ্ধা করে শর্মিলা l কেন যে অনুভূতিটা অন্য একটা মাত্রায় চলে গেল ! কিন্তু  ছাত্রী হিসেবে ওর প্রতি স্নেহ ছাড়া আর কোনো অনুভূতি কি আছে রিজ্জুদার? অসম্ভব একটা আলোড়ন শুরু হল  শর্মিলার মনের ভিতর l বয়ঃসন্ধির আবেগ যখন তখন চোখের জল হয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল l
সেদিন মৈত্রেয়ী আসেনি, শর্মিলা একাই বইখাতা খুলে বসেছিল l প্রিটেস্টের রেজাল্ট তেমন ভালো হয়নি, অপেক্ষাকৃত অনেক সহজ অঙ্কই মেলাতে পারেনি শর্মিলা l ঘরে ঢুকে খাতা দেখতে দেখতে গম্ভীরমুখে রিজ্জুদা বলল 
--আজকাল মোটেই পড়াশোনায় মন নেই তোমার l কি ভাবো বল তো সবসময়? 
--জানি না 
--জানো না? না,  বলবে না?  
--বলব না 
--বলতে হবে না l তোমার কি হয়েছে, আমি  জানি l 
--কি জানো?  বল, কি জানো?  
--এই বয়েসে যা হয় আর কি ! কাউকে ভালো লেগেছে তোমার ! কিন্তু তুমি কি জানো, যাকে ভালো লেগেছে  রেজাল্ট খারাপ হলে সে ফিরেও তাকাবে না তোমার দিকে ! 
ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল শর্মিলা l ওর ভেজা গালে হাত ছুঁইয়ে  রিজ্জুদা বলল 
--তোমার ওপর আমার অনেক আশা মুন্নি l আমার কথা একটু কম ভাবো আর পড়াশোনায় মন দাও l আমি তো আছিই... শুধু একটা কথা মাথায় রেখো l আমাদের মধ্যে কিন্তু অনেক বাধা রয়েছে l সেটা অতিক্রম করতে গেলে আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে তোমায় l

সেবার মাধ্যমিকে শর্মিলাদের স্কুলের বেশ ভালো  রেজাল্ট হল l তিপ্পান্নজন পরীক্ষার্থীর মধ্যে একুশজন ফার্স্ট ডিভিশন, আর বাকি সবাই সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছে l কেউ ফেল করেনি l একুশজনের মধ্যে পাঁচজন স্টার l দেখা গেল সৌমিলি নয়, মৈত্রেয়ী স্কুলের মধ্যে প্রথম হয়েছে l এমনকি কুড়িজনের মেধাতালিকায়ও  জায়গা করে নিয়েছে l কম্পালসারি আর অ্যাডিশনাল ম্যাথসসহ চারটে সাবজেক্টে লেটার পেয়েও মাত্র দু নম্বরের জন্য স্টার পেল না শর্মিলা l 

রেজাল্টের দিন সকালেই  ছোটকা কলেজস্ট্রিট থেকে গেজেট  কিনে নিয়ে এল l বাড়িতে সবাই উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল l বাড়ির প্রথম মেয়ের জীবনের প্রথম পরীক্ষার রেজাল্ট বলে কথা ! রেজাল্ট দেখে খানিকটা হতাশ হলেও মা বললেন  মাধ্যমিকের রেজাল্ট নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট ভালো করার চেষ্টা করতে হবে l পিসি, কাম্মা সবাই অবশ্য খুশি l শম্পাও ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিল l কেয়ামাসিও খুব খুশি l আগের বছর শর্বরীদি ফার্স্ট ডিভিশন পায়নি l ওদের সাফল্য উদযাপন করে দুবাড়িতে মিলে একদিন জমিয়ে খাওয়াদাওয়া হল l মা, আর কেয়ামাসি দুজনে মিলে অনেককিছু রান্না করলেন l সেদিন রাতে হঠাৎই মায়ের শরীরটা খুব খারাপ হল l মাথা ঘুরে রান্নাঘরে পড়ে গেলেন l ডাক্তার জেঠু বাড়িতে এসে প্রেশার মেপে বললেন ব্লাডপ্রেশার খুবই বেশী l আগুনতাতে আর রান্না করা চলবে না l ঈষৎ হাসলেন অপর্ণা l দুদিন ছুটি নিয়ে কাম্মা রান্নাবান্না করল l তারপর একজন রান্নার লোক রাখা হল l কিন্তু বাড়ির সবাই অপর্ণার রান্না খেয়ে অভ্যস্ত, লক্ষ্মীমাসির রান্না তাদের ভালো লাগবে কেন ! তাই প্রথমে অল্পস্বল্প হলেও পরে পুরোদমে রান্নাঘরে ঢুকতে শুরু করলেন অপর্ণা l ইতিমধ্যে অবশ্য শবনমের উদ্যোগে রান্নার গ্যাস এসেছে বাড়িতে l  

নিজের জন্য মনখারাপ হলেও মৈত্রেয়ীর জন্য খুব গর্ব হচ্ছিল শর্মিলার l স্কুল থেকেও  মৈত্রেয়ীকে সংবর্ধনা দেওয়া হল l ইলেভেনে ওরা প্রায় সবাই নিজেদের স্কুলেই ভর্তি হল l শম্পা, সাগরিকা, সুদেষ্ণারা আর্টস সেকশনে আর মৈত্রেয়ী, শর্মিলারা সায়েন্স সেকশনে l সৌমিলি চলে গেল অন্য স্কুলে l ওর বোন মেঘনা বলল 
--সৌমিলি বলেছে মৈত্রেয়ীর সঙ্গে এক স্কুলে পড়বে না l 
মেঘনার তখনও  ক্লাস নাইন l চুটিয়ে প্রেম করছে একজন উঠতি অভিনেতার সঙ্গে l ছেলেটি নাটক করে l দু - একটা সিনেমায় হিরোর বন্ধু বা ভাইয়ের পার্টে অভিনয় করেছে l মেঘনাও নাকি গ্রূপ থিয়েটারে যোগ দেবে l এর মাসদুয়েক পরেই হঠাৎ উধাও হয়ে গেল মেঘনা l সৌমিলির সঙ্গে দেখা হয় না শর্মিলাদের l ওদের ক্লাসের মেয়েদের কাছেই খবর পেল  মেঘনা বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে l

রিজ্জুদারও ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়ে গেল l জামশেদপুরে একটা স্টিল প্ল্যান্টে চাকরি পেয়ে গেল রিজ্জুদা l কোম্পানির কোয়ার্টারও পেয়ে গেল l মাসে একবার দুদিনের জন্য বাড়ি এলে শর্মিলার সঙ্গে দেখা হত l সপ্তাহে একটা করে চিঠি লিখত রিজ্জুদা l সেই চিঠিতে সুন্দর শহরটার বর্ণনা থেকে দেশের রাজনীতি, প্রতিবেশীদের কথা, শর্মিলার লেখাপড়ার খোঁজখবর সবই থাকত l কিন্তু কোনোভাবেই কোনো প্রেমের কথা লেখা থাকত না l মৈত্রেয়ী এই নিয়ে খুব রাগাত শর্মিলাকে l অবশ্য পোস্টে চিঠি এলে বাড়ির লোকজনের হাতে হামেশাই সে চিঠি পড়ত l শিক্ষক আর ছাত্রীর স্বাভাবিক সম্পর্ক বলেই বাড়ির কেউ সন্দেহ করত না কখনও l শুধু রিজ্জুদার চিঠি এলেই  মা মাঝে মাঝে কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাত শর্মিলার দিকে l 

স্যান্যাল স্যারের কোচিংয়েই ফিজিক্স আর ম্যাথস টিউশনে ভর্তি হল মৈত্রেয়ী আর শর্মিলা l শুভ্রকান্তি, ধ্রুব, অর্ণব সবাই একই ব্যাচে ভর্তি হয়েছে l ওদের স্কুলের আত্রেয়ীদির  কাছে বাড়িতে  কেমিস্ট্রির টিউশন l প্রথম ফিজিক্স ক্লাসের দিনই  মৈত্রেয়ীর খুব জ্বর, শর্মিলা একাই ফিরছিল টিউশন থেকে l সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে l অর্ণব সাইকেল নিয়ে ওর সঙ্গে  বাড়ি অবধি এল l 
--শর্মিলা তোকে না একটা কথা বলার ছিল l মানে.. ধ্রুব তোকে একটা কথা বলেছে l 
--কি কথা ?  ধ্রুব নিজে না বলে তোকে বলতে বলল কেন?  
খুব অবাক হল শর্মিলা l 
--তোকে এই চিঠিটা দিয়েছে ধ্রুব l 
ঘরে এসে চিঠি খুলে শর্মিলার চোখ ছানাবড়া ! এ তো প্রেমপত্র ! প্রতি লাইনে আবেগের বৃষ্টি ! সেই জন্যই কি ধ্রুব আজকাল বিশেষ কথা বলে না ওর সঙ্গে ! চোখ তুলে তাকায় না পর্যন্ত !
মৈত্রেয়ীকে বলার পর খুব হাসল ও l 
--এতদিনে তুই ঠিকঠাক প্রেমপত্র পেলি l রিজ্জুদাকে বরং পাঠিয়ে দে l কিভাবে প্রেমিকাকে চিঠি লিখতে হয় শিখে নিক l 
মজা করলেও এই সমস্যাটা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ল দুজনেই l ধ্রুব ভালো ছেলে, ওদের ভালো বন্ধু l শর্মিলার রিজেকশনে যদি ওর মানসিক কোনো ক্ষতি হয়ে যায় ! শর্মিলা জানে এই পর্যায়ে লেখাপড়ার কতটা ক্ষতি হয় l তবু ওকে তো বলতেই হবে সত্যিটা l পরেরদিন ক্লাসের পর ধ্রুবকে ডেকে মৈত্রেয়ী বলল 
--ধ্রুব, শর্মিলা একজনের কাছে কমিটেড l তুই প্লিজ  একটু বোঝ ব্যাপারটা l 
ধ্রুব একটাও কথা না বলে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল l পরেরদিন থেকে আর ক্লাসে এল না l অর্ণব বলত ধ্রুব  একদম পড়াশোনা করছে না l কতগুলো বাজে ছেলের সঙ্গে মিশছে l সিগারেট, গাঁজা খাচ্ছে l খুব খারাপ লাগত শর্মিলার l বিশেষত অর্ণবরা যখন বলত ওর জন্যই এত ভালো একটা ছেলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ! কিন্তু ওই বা কি করবে ! সেই মাসে রিজ্জুদা আসার পর সব কথা বলার পর ওকে অকারণ অপরাধবোধে বিক্ষত হতে দেখে রিজ্জুদা মৈত্রেয়ীকে বলল 
--তুমি ধ্রুবদের বাড়িটা চেনো? আমি আজ ওদের বাড়িতে যাবো l ওর গার্ডিয়ানদের সবটা খুলে বলব l ওকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিলে হয়ত ওর পক্ষে ভালো হবে l এখানে থাকলে ওর ক্যারিয়ারটা শেষ হয়ে যাবে l আর শর্মিলারও লেখাপড়া হবে না l অন্য পরিবেশে ও একটা ফ্রেশ স্টার্ট করতে পারবে l

কিছুদিন পরে অর্ণব বলল ধ্রুব ওর মাসির সঙ্গে যাদবপুরে চলে গেছে l এবার থেকে ওখানেই থাকবে l ওখানকার একটা স্কুলেই ট্রান্সফার নিয়ে নিয়েছে l 

(চলবে )

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন