রবিবার, ৬ জুন, ২০২১

অমিভাভ সরকার

                                                                  



বেজন্মা 

তৃতীয় ভাগের পর 


‘আমি একজনের খোঁজ করছি। তাঁর ভাইপো আমার সঙ্গে বিএসএফ-এ কাজ করেন’। কৃষাণ ওয়ালেট থেকে বের করে কাগজের টুকরোটা এগিয়ে দেয়।     

‘ও আপনি বিএসএফ-এ আছেন!’ মনে হলো জবাব শুনে মনে হলো ভদ্রলোক একটু নিশ্চিন্ত হলেন। কাগজটা নিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে পাশের মাঠে পিট্টু খেলতে থাকা কয়েকজন কিশোরের মধ্যে একজনকে ডাক দিলেন। কিশোরটির পিছুপিছু গলি পেরিয়ে গ্রামের প্রান্তে একতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল কৃষাণ।

মাটির একতলা বাড়ী, বহুদিন নিকানো হয় নি, দেওয়ালে অযত্নের ছাপ। সামনে কয়েকটি ছাগল বাঁধা…। দারিদ্র্যের স্পষ্ট চিহ্ন বাড়ির চারদিক। কিশোরটির ‘চাচী…, চাচী…’ ডাক শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন রঙচটা হালকা রঙের শাড়ী পরা রুগ্নসার বছর পঞ্চাশেক মহিলা। মাথায় দেওয়া কাপড়ের ছেঁড়া অংশটা বার বার চোখ আটকে যাচ্ছিল কৃষাণের। 

‘চাচী, এই লোকটা তোমার খোঁজ করছে’। বলেই দৌড়ে চলে যায় ছেলেটি। ভদ্রমহিলা একটা মোড়া এগিয়ে দিলেন কৃষাণের দিকে।      

“আপনি এখানে বসুন। খোঁজ করছিলেন আমাকে…?” 

“আমার নাম কৃষাণ। আপনার ভাইপো শামসুদ্দিন, মানে আকবর চাচার ছেলে, যিনি বাংলাদেশে থাকেন, আমার বন্ধু”। কৃষাণ ভদ্রমহিলাকে প্রণাম করে শাড়ীর প্যাকেটটা এগিয়ে দেয়। শাড়ীর পাট খুলতেই একটা খাম পড়ে মাটিতে। শামসুদ্দিন এই খামের কথা বলে নি তাকে! ভদ্রমহিলা খামটা খুলে একটা চিঠি বের করেন। কৃষাণ লক্ষ্য করল, চিঠি পড়তে পড়তে ভদ্রমহিলার চোখদুটি জলে ভরে উঠেছে। দুচোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গালে গড়িয়ে পড়ল। কৃষাণের দিকে চোখ যেতেই সামলে নিলেন নিজেকে। চিঠি পড়া শেষ করে কৃষাণকে ঘরের ভেতরে ডাকলেন ভদ্রমহিলা।

ঘরে একটা শোওয়ার চৌকি, তাতে শীতলপাটি পাতা, বিছানার তোশক, বালিস সহ একদিকে গোটানো। একপাশে একটা টেবিল ও চেয়ার। টেবিলের ওপর ডাঁই করা স্কুলের বই। ভদ্রমহিলা গোটানো বিছানা খুলে চাদর টান করে কৃষাণকে বসতে বললেন। ঘরে ঢুকেই কৃষাণ ভদ্রলোকের বর্ণনা দিয়ে, তাঁকে বলা মিথ্যে কথাগুলি জানিয়ে দেয়। বর্ণনা শুনে ভদ্রমহিলা জানান, খুব সম্ভব তিনি গ্রামের মেম্বারের সঙ্গে কথা হয়েছে কৃষাণের। বলতে বলতে তিনি ভেতরে পাশের ঘরে চলে যান। একটু পরে ফিরে এসে একটা প্লেট এগিয়ে দেন কৃষাণকে।

“এটা খেয়ে নাও বাবা, ঘরে তো কিছুই নেই, কয়েকটি মুরগীর ডিম ছিল, তাই দিয়েই… কী ভাবে যে যত্ন করবো, শামসুদ্দিনের বন্ধু তুমি…”। 

“কি গো ভাবি, কে এসেছে তোমার ঘরে? তোমার তো আত্মীয়স্বজন আছে বলে শুনি নি”। কৃষাণ দরজায় উঁকি দিয়ে দেখলো, সেই ভদ্রলোক এসেছেন। শামসুদ্দিনের ফুফু তাড়াতাড়ি বাইরে গিয়ে ডাক দিলেন ভদ্রলোককে।    

“হ্যাঁ গো ঠাকুর, আমার ভাইজানের ব্যাটার বন্ধু, একসঙ্গে কাজ করে মিলিটারিতে। ভেতরে এসো, একটু চা খেয়ে যাও”। তাদের কথাবার্তার মাঝে কৃষাণ ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায়।

“ভেতরে আসুন না স্যার…”। কৃষাণের কথা শুনে হো হো করে হাসলেন ভদ্রলোক।

“আরে মশাই আমি সার, টার কিছু নই। আমি গ্রামেই থাকি, সকলের ভালো-মন্দ খোঁজ খবর করি, তাই ভালোবাসে আমাকে এরা। তা কত দিনের জন্য ?”

“এই তো দুই, তিনদিন এখানে থেকেই চলে যাব। তারপর কয়েকটা জায়গা ঘুরে আবার ফোর্সে ফিরে যাব। আমার তো তিন কুলে কেউ নেই, যে…”। কথাটা মুখ ফসকেই বলে ফেলে কৃষাণ।

“তিন কুলে নেই মানে? বাবা মা…?” কোথায় থাকেন? কৃষাণ বুঝলো, তাকে পরখ করে নিতে চাইছেন ভদ্রলোক। কৃষাণ সামলে নেয় নিজেকে।

“বাবা-মা গত হয়েছেন কয়েক বছর হলো। থাকতাম হাওড়ায় আন্দুলের কাছে একটা গ্রামে…”।    

“বুঝলাম, তা থেকে যান এখানে কিছুদিন। কোথায় উঠেছেন?”

“লাভপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটা লজে, ‘অতিথি নিবাস’-এ। ভদ্রলোক আর কথা বাড়ালেন না…।

“ভাবি, লজ থেকে ফৌজি ভাইকে বাড়িতে নিয়ে এসো। ক’দিন রাখো, আদর যত্ন করো, ভাইপো বলে কথা…। চললাম ফৌজি ভাই। এদিকে এলে দেখা করবেন”। ভদ্রলোক বিদায় নেবার পর ঘরে ঢুকে বসলো কৃষাণ। ইতিমধ্যে চা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। ভদ্রমহিলা আবার চা করে দিতে চাইছিলেন, কিন্তু কৃষাণ বারণ করল তাঁকে।  

“তুমি ওঁকে বলছিলে, তোমার কেউ নেই…!”

“হ্যাঁ পিসিমা, বাবা, মা কাউকে দেখিনিই কোনোদিন। সেই ছোট্টবেলা থেকে অনাথ আশ্রমেই বড় হওয়া। আমার ‘কৃষাণ’ নামটাও আশ্রমের দারোয়ান কাকার দেওয়া। আমার এই রঙ দেখে দারোয়ান কাকা নাম দিয়েছিলেন ‘কিষণ’। কী করে যে ‘কৃষাণ’ হয়ে গেল, বুঝতে পারিনি”। বলতে বলতে হেসে ফেলে কৃষাণ। হঠাৎ চোখ যায় টেবিলে রাখা পাঠ্য পুস্তকগুলির দিকে, সেখানে একটা পুরনো টেস্ট পেপার দেখতে পায় সে।

“পিসিমা, আপনারা এখানে কে কে থাকেন? টেবিলে একটা টেস্ট পেপার দেখছি…”।   

“ওগুলো আমার মেয়ে রাবেয়ার, হাইয়ার সেকেন্ডারি দেবে। ওর আব্বু মারা যান বছর দেড়েক হলো। যা কিছু জায়গা জমি ছিল, তার বেশীর ভাগই বিক্রি করতে হয়েছে। এখন এই বসত বাড়িটুকুই আছে”। 

“কিছু মনে করবেন না পিসিমা, আপনাদের চলে কী ভাবে…?”         

“সেই ভাবে কি চলে বাবা… ছাগল, মুরগী আর সামান্য জমি আছে, তাই দিয়ে চলে যায় কোনও রকমে। মেয়ে পড়াশোনার খরচ বাচ্চাদের পড়িয়ে নিজেই জোগার করে। মেয়ে বড় হয়েছে, নিকা করার জন্য অনেকেই মুখিয়ে আছে…। নানা জায়গা থেকে প্রস্তাবও এসেছে। সেগুলি যে খুব ভাল, তা অবশ্য নয়। মেয়ে ইচ্ছে আরো পড়ার। জানি না কতদূর পড়াতে পারবো। আমার তো জীবনের একটাই দায়…”।    

উঠে দাঁড়ায় কৃষাণ। “

ক্রমশঃ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন